`ডর ঢুকি গেছে ভিতরে'

নিজস্ব প্রতিবেদক


মে ০৪, ২০২০
১০:৪২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ০৪, ২০২০
১০:৪২ পূর্বাহ্ন



`ডর ঢুকি গেছে ভিতরে'

‘ডর ঢুকি গেছে ভিতরে’ কথাটা বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আবেদ হোসেন। বেসরকারি এই চাকুরিজীবীর বাসা সিলেট নগরের কাজলশাহ এলাকায়। একমাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি ঘরবন্দী। বলেন, ‘ঘরে বসে থাকতে থাকতে অসহ্য লাগে। দুপুরের পর করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনটা লাইভ দেখি। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটা শুনতে শুনতে হতাশ হয়ে পড়ি। কী যে আছে সামনে!’

আবেদ হোসেনের মতো অনেকেই গতকাল রবিবার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সিলেট মিরর-এর এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা জানালেন, এই যে এতসংখ্যক মানুষের শরীরে প্রতিদিনই করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে, এটি দেখেও তো কারও মধ্যে কোনো বোধদয় হচ্ছে না। সিলেটের হাটবাজারে মানুষের ভিড় তো রয়েছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ভেতরে জটলা বেঁধে আড্ডা দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ব্যাংকগুলোতে সামাজিক দূরত্ব না মেনে শরীরে শরীর ঘেঁষে মানুষজন সারিবদ্ধভাবে টাকা উত্তোলন করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন। সবজি ও মাছবাজারেও একই দৃশ্য। 

কয়েকজন কাপড়ের ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রথম দেড় মাস তাঁদের কোনো রকমে অতিবাহিত হলেও এখন চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণে সরকারের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যবসায়ীদের দুরবস্থা দূর করতে সহজ শর্তে ব্যাংকগুলো যদি ঋণ দেয়, তাহলে এ সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। নতুবা ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে খুবই সমস্যা হবে। তাই এ দিকটিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।   

মানুষজনের এই অসচেতনতা নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তবে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ আবার কর্মহীন হয়ে পড়ে সমস্যার কবলে পড়ে যাওয়ায় খেদও প্রকাশ করলেন। পনিটুলা এলাকার গৃহ পরিচারিকা আছমা আক্তার জানান, তিনি চারটি বাসায় গৃহ পরিচারিকার কাজ করতেন। এ থেকে তাঁর যে আয় হতো, তা দিয়েই ছয় সদস্যের সংসার চালাতেন। কিন্তু গত দুই মাস ধরে তাঁর কাজ বন্ধ। মার্চ মাসের বেতন বাসার মালিকেরা তাঁকে দিলেও এপ্রিল মাসের বেতন পাননি। একটি সংগঠনের মাধ্যমে চাল-ডাল-তেল-পেঁয়াজ-লবণ পেয়েছিলেন। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। সামনের দিনগুলোতে কী খেয়ে বাঁচবেন, তাই নিয়ে তাঁর কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকায় গতকাল রবিবার দুপুরে ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিক ও দিনমজুররা। এঁদের মধ্যে দুজন জানিয়েছেন, ত্রাণ সকলে পাচ্ছেন না। অথচ খাদ্যসামগ্রীর তীব্র সংকটে ভুগছেন তাঁরা। পরে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা বিক্ষোভ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন। মেয়র তাঁদের জানিয়েছেন, পর্যায়ক্রমে সকলেই ত্রাণ সহায়তা পাবেন। নগরের বালুচর এলাকার একজন রিকশাচালক জানিয়েছেন, তিনি প্রতিদিনই রিকশা নিয়ে বের হন। কিন্তু যাত্রী সেভাবে পান না। প্রতিদিন এখন তাঁর আয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা হয়। সে টাকা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চালাচ্ছেন। এ অবস্থা যদি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকে, তাহলে তাঁর অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়বে।

ভাতালিয়া এলাকার বাসিন্দা মুক্তার হোসেন জানান, সিলেট নগরে তুলনামূলকভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা নেই। সেই অর্থে হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা অনেক বেশি। সেটি তাঁকে খুব ভাবাচ্ছে। এ দুটি জেলা পুরো বিভাগের জন্য শেষ পর্যন্ত ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি না, তা নিয়েই তিনি বেশি ভয় পাচ্ছেন। তবে জেলা দুটিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা মানুষদের কোয়ারেন্টিন সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে পারলে এমন অবস্থা তৈরি হতো না বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে তিনি আরও জানিয়েছেন, সিলেটের হাটবাজার এবং গ্রামীণ জনপদগুলোতে সামাজিক দূরত্বে নিশ্চিতে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে। 

বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা নিরোদ চন্দ্র দাশ বলেন, ‘এখন প্রতিদিন ঘুমাতে যাই ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে। আবার ঘুম থেকে সকাল বেলা উঠিও ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে। টিভি দেখা আর খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এ রকম বন্দীজীবন আর কতদিন ভালো লাগে? দ্রæত করোনাকাল কেটে গেলেই বাঁচি।’ জিন্দাবাজার এলাকার একটি বিপণিবিতানের কাপড়ের ব্যবসায়ী খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘সামনে ঈদ, অথচ দোকান বন্ধ। গেল পয়লা বৈশাখেও দোকান বন্ধ ছিল। কতদিন এই পরিস্থিতি থাকবে, বুঝে উঠতে পারছি না। এই রকম হলে তো পথে বসতে হবে।’      

 

এস-০১/এএফ-০১