এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস : জ্বরের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার

ডা. গোবিন্দ কর্মকার


আগস্ট ২০, ২০২৩
০২:২৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ২০, ২০২৩
০২:৩০ পূর্বাহ্ন



এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস : জ্বরের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার


ডেঙ্গু জ্বর (সমার্থক ভিন্ন বানান ডেঙ্গি) একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গু জ্বরের সময়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমন ঘটে। সময় এবং অঞ্চল বিশেষে এই রোগে মহামারীর আকারও ধারণ করে। এ বছর ডেঙ্গু জ্বর ঢাকাতে ভায়বহ রূপ ধারণ করেছে। সিলেটেও প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বর বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও)। চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৪৮৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। যার মধ্যে ৬২ শতাংশ শনাক্ত এবং ৬৩ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে গেল জুলাই মাসে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার বেড়ে ০.৪৭ শতাংশ পৌঁছেছে যা গত ০৫ বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বিনা চিকিৎসায় ভুল চিকিৎসায় এবং দেরিতে চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।


কারণ: 

এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগে কেউ তখনই আক্রান্ত হয়, যখন মশা সংক্রমিত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ে, তারপর ভাইরাস বহন করার সময় একজন অ-সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয়। কামড় দেয়ার পর ভাইরাস সংক্রমন তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ আসে।


লক্ষণ:

হঠাৎ করে তীব্র জ্বর (১০২০-১০৪০)

তীব্র মাথা ব্যাথা

চোখের পেছনের অংশে ব্যথা

সম্পূর্ণ শরীরে তীব্র ব্যথা সঙ্গে কোমরে ব্যথা

বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া

রত্বকে র‌্যাশ, কিংবা লাল দানা দানা দেখা দেওয়া

সিভিয়ার ডেঙ্গুর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) ক্ষেত্রে তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্ত বমি, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরন, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরন, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হওয়া। শরীর ক্লান্ত অনুভব বা বমি হওয়া, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং ঘুম ঘুম ভাব, চেতনা হারানো।

ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম থেকে মানবদেহে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে নাড়ীর গতিমাত্রা অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়।


ডেঙ্গুর গুরুতর (Warning) উপসর্গ: 

প্রচন্ড পেটে ব্যাথা

ক্রমাগত বমি হওয়া

শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ

শরীরের বিভিন্ন অংশে পানি জমা।

ক্লান্তি, অবসন্নতা, অস্থিরতাভাব।

লিভার ২ সি.সি. এর বেশি বড় হওয়া।

প্রস্রাব কমে গেলে অথবা লাল প্রস্রাব হলে।

যাদের চিকিৎসা বাড়িতে হবে 

সাধারণ (গরষফ) ডেঙ্গু জ্বর যাদের গুরুতর লক্ষণ (ডধৎহরহম) থাকবে না।

যাদের চিকিৎসা হাসপাতালে হবে 

ডেঙ্গু জ্বর এর সাথে গুরুতর লক্ষণ থাকলে।

ডেঙ্গু জ্বর এর সাথে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রোগ, কিডনী রোগ, লিভারের রোগ থাকলে।

শিশুদের বয়স্কদের এবং গর্ভবতী মায়ের ডেঙ্গু অথবা যাদের দেখার কেউ নেই এমন কারো ডেঙ্গু হলে।


প্রতিকার 

বাড়ির আশপাশ যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে চেষ্টা করুন।

ঘরের ভেতরে অথবা ছাদে থাকা ফলের টব, ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, টায়ার অথবা পলিথিন থাকলে তা দ্রুত পরিস্কার করে ফেলুন এবং ফুলের টব থেকে জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করুন।

মশা নিধনের জন্য সপ্তাহে অন্তত তিনবার স্প্রে বা ফগিং করুন।

বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মশা নিধনে ব্যবহৃত ক্রিম রাখতে পারেন সঙ্গে।

সন্ধ্যার পর বাড়ির ছোট থেকে বড় সদস্যরা মশারি ব্যবহার করুন।

যেখানে সেখানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করে ফেলুন কারণ এতে এডিস মশা ডিম পেড়ে থাকে এই সময়।

এডিস মশা যেহেতু দিনেও কামড়ায়, তাই দিনের বেলায়ও ঘুমানোর সময় মশারী ব্যবহার করতে হবে এবং বাইরে যেতে লম্বা হাতার জামা কাপড় পড়তে হবে।


ডেঙ্গু হলে যা করবেন না 

আপনি যদি ডেঙ্গুতে জ্বর এবং শরীরে ব্যথা অনুভব করেন তবে নিজে নিজে কোনো ঔষধ ব্যবহার করবেন না।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ, স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হতে বিরত থাকুন।

প্লাটিলেট সংখ্যা কম হওয়া নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে চিকিৎসক এর উপদেশ না নিয়ে রক্ত বা প্লাটিলেট দিবেন না।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা খুব জরুরি। এর সাথে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত দরকার। অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হয়ে যায়। শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। তাই নগরবাসীকে আরেকটু সজাগ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে, দ্বিতীয় ডেঙ্গু সংক্রমন মারাত্মক হতে পারে।

সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং ভালো থাকুন। প্রয়োজনে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।


লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); এফসিপিএস (মেডিসিন); এমএসিপি (আমেরিকা); কনসালটেন্ট (মেডিসিন) সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল


এএফ/০৩