নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ১৯, ২০২১
০৫:১৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ১৯, ২০২১
০৫:১৪ পূর্বাহ্ন
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কালীকৃষ্ণপুর গ্রাম। হাকালুকির বুকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন একটি জনপদ। গ্রামের অভ্যন্তরে চলাচলের একমাত্র সড়কটিও প্রায় নিশ্চিহ্ন। হাওরের ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে জীবন চলা প্রায় ৫ হাজার লোকের বসতি এই গ্রামে।
অবহেলিত জনপদ কালীকৃষ্ণপুরের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে এতদিনে কারও চোখ পড়েনি। অবশেষে সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন গ্রামের প্রবাসীরা। নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ করে ৫০ লাখ টাকা খরচে নির্মাণ করছেন সময়োপযোগী ও টেকসই সড়ক। এরই মধ্যে সড়কের গার্ডওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রায় একশ বছর আগে এই এলাকায় বসতি গড়ে উঠে। এরপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় সড়ক নির্মাণ করেন। গ্রামবাসীও নিজেদের শ্রমে সড়ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। তবে, তা পরিকল্পিতভাবে ছিল না। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক নির্মাণ করা হলে বর্ষায় জল থৈ থৈ হাওরের ঢেউ আছড়ে পড়ে এই সড়কে। বর্ষায় পানির নিচে থাকে সড়কটি। তখন এই গ্রামের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয় নৌকা।
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, উপজেলা সদর থেকে দূরত্ব বেশি হওয়ায় বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেটে হাওর পাড়ি দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জে যান এই এলাকার লোকজন।
সম্প্রতি ঐ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পূর্বপ্রান্ত থেকে গার্ডওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় আধাকিলোমিটার এলাকায় গার্ডওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কের একপাশে গাইজুরা নদী, উত্তরে জলভরা হাকালুকি। পনাইরচক হাইস্কুল থেকে লামা কালীকৃষ্ণপুর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার মাটির সড়ক রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা কাজী বেলাল আহমদ জানান, বর্ষায় হাকালুকি হাওরের পানি বাড়ার সঙ্গে তলিয়ে যায় সড়কটি। প্রতিবছর এই সময়ে গ্রামের মানুষ যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নৌকায় মানুষের চলাচল করতে হয়। তখন বাজার সদাই বা চিকিৎসার প্রয়োজনে নৌকাযোগে বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জে যাই আমরা।
গাইজুরা নদী (বরুধল নদী) উত্তর তীরে অবস্থিত নূরজাহানপুর শেষ হতেই শুরু হয়েছে কালীকৃষ্ণপুর। এখান থেকে গ্রামের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই গ্রাম। গ্রামের পূর্বপ্রান্তে আধাকিলোমিটার বা তারও চেয়ে কিছুটা বেশি অংশে সড়ক এখনও টিকে আছে। এরপরই সড়ক প্রায় নিশ্চিহ্ন। ঠিক সেখানেই রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত কালীকৃষ্ণপুর এসইএসডিপি মডেল হাইস্কুল। এখান থেকে সড়কটি অনেকটা তলানীতে মিশেছে।
স্থানীয় যুবক মোহাম্মদ বায়োজিদ জানান, গোলাপগঞ্জ উপজেলায় অনেক উন্নয়ন হলেও কুশিয়ারার দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দারা উন্নয়নবঞ্চিত। আর নদী থেকে আরও একটু দূরে হাওরপাড়ের গ্রামগুলোর বঞ্চনার ইতিহাস আরও দীর্ঘ। বিশেষ করে গাইজুরা নদীর তীববর্তী কালীকৃষ্ণপুর ও ইসলামপুর গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। এ কারণে শিক্ষাদীক্ষায়ও পিছিয়ে আছে এলাকার ছেলেমেয়েরা।
ইসলামপুর গ্রামের সালমান আমীর নামের এক যুবক জানান, বৈষম্যের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নবঞ্চিত তাদের গ্রাম। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমরা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের নজরে এনেছি। তিনি আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু, দূর্ভাগ্য আমাদের এতদিনেও সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
তাই, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা তাদের গ্রামের প্রবাসীরা উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের অর্থায়নে সড়কটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। সড়কটি এমনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে বর্ষায় পানিতে ডুবে না যায়। সেজন্য উচ্চতা বাড়িয়ে এবং ভাঙন থেকে বাঁচাতে দুই কিলোমিটার সড়কের পাশে গার্ডওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানান আমীর।
সড়ক যোগাযোগ না থাকায় চিকিৎসাসেবা এবং শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত রয়েছেন কালীকৃষ্ণপুর গ্রামের নারী ও শিশুরা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইসলামপুর গ্রামেও প্রায় ৫ হাজার মানুষের বসবাস। নদী পাড়ি দিয়ে তাদেরও চলাচল করতে হয় কালীকৃষ্ণপুর গ্রামের সড়কে।
গ্রামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকও নেই জানিয়ে পল্লী চিকিৎসক মীর আবু কাউসার বলেন, ‘গ্রামের নারী-শিশু-বৃদ্ধ অধিকাংশই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। ৬ কিলোমিটার দূরে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তারা কেউ কেউ ফেঞ্চুগঞ্জ বা সিলেট শহরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেন।’
উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। এদের মধ্যে মুক্তার আলী, খুরশেদ আলী, ওমর ফারুক, আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান, সাইদুল মাস্টার, এমান হোসেন নামের কয়েকজন প্রবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবার কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন এবং গ্রামের মানুষের দুর্দশা নিরসনের উদ্যোগ নেন।
এ বিষয়ে শরিফগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ মুছাব্বির বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় পনাইরচক-কালীকৃষ্ণপুর সড়ক উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু, বর্ষায় হাকালুকির ঢেউয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায় সড়কটি।’ তিনি এ বিষয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তবে, এই সড়কটি মজবুত করে নির্মাণ করতে হলে যে বাজেট দরকার তা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এসএইচ/আরসি-০২