নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট ১৭, ২০২১
০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ১৭, ২০২১
০৫:৩০ পূর্বাহ্ন
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরে তিনদিনের ব্যবধানে একই মাদরাসার তিন ছাত্র নিখোঁজ হয়েছে। এখনও তাদের খোঁজ মিলেনি। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের উদ্বেগ বাড়ছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের মোগলাবাজার ও দক্ষিণ সুরমা থানা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। নিখোঁজ তিনজনই জালালপুরে অবস্থিত মঞ্জলাল দারুল হিফজ ও দারুল ক্বিরাত মাদরাসার ছাত্র। এর মধ্যে গত ৩১ জুলাই সকাল ৯টার দিকে মাদরাসা থেকে নিখোঁজ হয় মো. হোসাইন আহমদ রুহান (১৬) ও মো. নাহিম আহমদ (১৮)। এর তিনদিন পর ৩ আগস্ট একই মাদরাসার ছাত্র সাজ্জাদ মিয়া (১৬) নিখোঁজ হয়।
রুহান মোগলাবাজারের উত্তর করিমপুর গ্রামের নুরুল হকের ছেলে এবং নাহিম একই থানার সমসপুর গ্রামের মৃত লয়লু মিয়ার ছেলে। এছাড়া সাজ্জাদ দক্ষিণ সুরমার বদিকোনার মৃত জয়নাল আবেদিন ভুঁইয়ার ছেলে। তাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উশারা সুলতানপুর গ্রামে।
এই তিন কিশোরের নিখোঁজের সংবাদ এমন সময়ে প্রকাশ্যে এল যখন সিলেটে অবস্থানরত এক যুবক আফগানিস্তানে তালেবানে যোগ দেওয়ার খবর বেরিয়েছে। এ কারণে আরও উদ্বেগ বেড়েছে।
রোহান ও নাহিম নিখোঁজের বিষয়ে গত ১ আগস্ট মোগলাবাজার থানায় সাধারণ ডায়রি করেন মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হাফিজুল ইসলাম। যার নম্বর ৫১।
এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘৩১ জুলাই ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত রুহান ও নাহিম পড়াশুনা করছিল। পৌঁনে ১০টা থেকে তাদেরকে খোঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের অভিভাবকদের এ বিষয়টি অবগত করা হয়। কিন্তু, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাদের সন্ধান মিলেনি। নিখোঁজের সময় তাদের গায়ে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা ছিল।’
রুহানের বাবা নূরুল হক বলেন, ‘মাদরাসা থেকে হুজুর কল দিয়ে বলেছেন রুহান মাদরাসায় নেই। সে বাড়িতেও আসেনি। থানায় জিডি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হুজুর বলেছেন, তারা জিডি করেছেন। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেছি কিন্তু পাইনি। শুনেছি তার সঙ্গে আরও দুটি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
নিখোঁজ নাহিমের মামা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রুহানের সঙ্গে নাহিমও মাদরাসায় গিয়েছিল। কিন্তু পরে মাদরাসার হুজুর জানিয়েছেন- তারা মাদরাসায় নেই। এরপর অনেক জায়গায় খোঁজ করেছি কিন্তু পাচ্ছি না। ছেলেটার বাবা নেই। মা একা কিছু করতে পারছেন না। এই অবস্থায় কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।’
এরপর ৩ আগস্ট দক্ষিণ সুরমার বলদি-বদিকোনা এলাকা থেকে মাদরাসার উদ্দেশ্যে বের হয় সাজ্জাদ। ৫ আগস্ট পরিবারের সদস্যরা তার খোঁজ নিতে মাদরাসায় যোগাযোগ করলে জানতে পারেন সে যায়নি। খোঁজাখুজির পর সাজ্জাদের সন্ধান চেয়ে গত ৮ আগস্ট সাজ্জাদ মিয়ার বোন রাশেদা বেগম দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। যার নম্বর-৩৩০।
রাশেদা বেগম জানান, ২৭ জুলাই তার বাবার মৃত্যু হয়। এরপর ৩ আগস্ট তার ভাই মাদরাসায় যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়। ৫ আগস্ট তারা মাদরাসার প্রধান শিক্ষককে ফোন দিয়ে ভাইয়ের খোঁজ নিলে জানতে পারেন ভাই মাদরাসায় যায়নি।
তিনি বলেন, ‘সাজ্জাদ কিছুটা সহজ-সরল। নিজস্ব মোবাইল ফোন নেই। বাড়িতে এলে বাসার মোবাইল নম্বর থেকে রুহানের সঙ্গে কথা বলতো। রুহানের নিজস্ব মোবাইল ফোন ছিল। বিষয়টি তার পরিবারও জানতো না বলে আমরা পরে জেনেছি। রুহানই আমার ভাইকে নিয়ে কোথাও গেছে।’
মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হাফিজুল ইসলাম সিলেট মিররকে বলেন, ‘রুহান ও নাহিম মাদরাসা থেকে নিখোঁজ হওয়ায় থানায় সাধারণ ডায়রি করেছি। কিন্তু, সাজ্জাদ নামের ছেলেটি বাড়িতে ছিল। আমরা জানতাম না সাজ্জাদও নিখোঁজ হয়েছে। তবে, তার পরিবার থেকে ৫ তারিখ যখন বলা হয়েছে তখন জেনেছি।’
মোগলাবাজার থানায় সাধারণ ডায়রির বিষয়টি তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপপরিদর্শক শাহীন কবির জানান, ২ আগস্ট পর্যন্ত রুহানের মোবাইলের অবস্থান ছিল সিলেট রেলস্টেশন এলাকায়। এরপর বারবার সিম পরিবর্তন হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সাজ্জাদ মিয়া নামে একটি ছেলে নিখোঁজের বিষয়ে জিডি হয়েছে। তার সঙ্গে আরও দুটি ছেলে আছে বলে জানা গেছে। তারা একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও বার বার এটা সিম বদলাচ্ছে। সর্বশেষ ট্রাকিং অনুযায়ী তারা ময়মনসিংহের দিকে ছিল। আশা করি তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘এভাবে তিনজন ছাত্র নিখোঁজের বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ সম্প্রতি তালেবান ইস্যুতে বাংলাদেশের কিশোর-যুবকদের সম্পৃক্ততার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে আমরা এই ব্যাপারটা সিরিয়াসলি দেখছি।’
মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময় পরিবারের চাপে অনেক শিশুকে মাদরাসায় পাঠানো হয়। চাপ সইতে না পেরে শিশুদের কেউ কেউ পালিয়ে বাড়িতে বা অন্য কোথাও চলে যায়। এর আগেও দক্ষিণ সুরমায় একাধিক ঘটনা ঘটেছে। গত জুনে দক্ষিণ সুরমার আহমদপুর থেকে মাদরাসা শিক্ষার্থী তিন শিশু নিখোঁজ হয়। এর দুদিন পর জাফলং জিরো পয়েন্টে থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। প্রায় এক বছর আগে মোগলাবাজারের মঞ্জলাল মাদরাসা থেকে তিনজন ছাত্র রাতে মাদরাসা বোর্ডিং থেকে পালিয়ে যায়। পরে, মোগলাবাজার থানা পুলিশ তাদেরকে আটক করে মাদরাসার শিক্ষকদের খবর দেয়। এরপর তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সম্প্রতি আব্দুর রাজ্জাক নামে সিলেটের মদনমোহন কলেজের এক ছাত্র তালেবনাদের হয়ে লড়তে আফগানিস্তান চলে যাওয়ার খবর জানায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ‘বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার’ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আফগানিস্তান চলে যান রাজ্জাক। রাজ্জাকের আফগানিস্তান যাওয়া নিয়ে আলোচনার মধ্যেই সিলেটের এই তিন ছাত্র নিখোঁজের খবর নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়েছে।
এসএইচ/আরসি-০১