সিলেটে গ্রেনেড হামলা: বিচার ঝুলে আছে ১৭ বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক


আগস্ট ০৭, ২০২১
০৪:৫৪ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ০৭, ২০২১
০৪:৫৪ অপরাহ্ন



সিলেটে গ্রেনেড হামলা: বিচার ঝুলে আছে ১৭ বছর

সিলেটের গুলশান সেন্টারে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি ১৭ বছরেও। ২০০৪ সালে সংঘটিত এই ঘটনায় দুটি মামলা হলেও একটি মামলা অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে লেগে যায় ১০ বছর। আর অন্য মামলাটির অভিযোগ গঠন করতেই লেগেছে ১৪ বছর। 

সিলেট নগরের তালতলা এলাকায় অবস্থিত গুলশান সেন্টারে ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ছিল। সভায় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। রাত পৌণে আটটার দিকে সভা শেষ হয়। সভা শেষে বের হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন অনেকে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। এরপর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান স্থান ত্যাগ করার মুহুর্তেই তার গাড়ির পাশে রাখা একটি গাড়িটিতে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। বিকট শব্দে বিস্ফোরণে গাড়িটিতে আগুন ধরে যায় এবং সমস্ত এলাকা ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে পাশের অপর একটি গাড়িও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। 

হামলার এ ঘটনায় নিহত হন তৎকালীন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ইব্রাহিম আলী। আহত হন তৎকালীন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী, তুহিন কুমার দাস মিকন, আনোয়ার হোসেন রানা, ফয়জুল আনোয়ার আলাওর, অ্যাডভোকেট মফুর আলী, কবির আহমদ, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাকির হোসেন, তপন মিত্র, এটিএম হাসান জেবুল, আজম খানসহ  প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী। 

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ২০০৪ সালের ৮ আগস্ট কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা করেন। প্রথমে মামলা দুটি পুলিশ তদন্ত করলেও পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইড) তদন্তের দায়িত দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সিআইডির পরিদর্শক জুবের আহমদ আদালতে বিস্ফোরক মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, হুজির সিলেট অঞ্চলের নেতা শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুলসহ আট জঙ্গিকে অভিযুক্ত করা হয়। 

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দিলে অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রওনকুল হক চৌধুরী আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে নতুন করে দুজনকে অভিযুক্ত করা হয় এবং দুজনের নাম বাদ দেওয়া হয়। নতুন যাদের অভিযুক্ত করা হয় তারা হলেন, মাওলানা তাজ উদ্দিন ও ‘কাশ্মীরি জঙ্গি’ আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট। 

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মহেশ ভাট একজন কাশ্মীরী জঙ্গি। জন্মসূত্রে সে ভারতীয় নাগরিক। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। আর তাজ উদ্দিন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত এবং পলাতক রয়েছে। 

সম্পূরক চার্জশিটে অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, মো. শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে দীপু, হুমায়ুন কবির ওরফে হিমু, মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল, মফিজুল ইসলাম ওরফে মহিবুল্লাহ, দেলওয়ার হোসেন রিপন। 

এ ছাড়া আহসান উল্লাহ ওরফে কাজল মারা যাওয়ায় এবং ফখরুল ইসলাম ফাহিমের পূর্ণ ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। 

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে বিস্ফোরক মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু হয়। মামলায় সাক্ষী রয়েছেন ৬৮ জন। মামলার অর্ধেক সাক্ষীর সাক্ষ্যগহণ হয়েছে বলে জানা গেছে। 

আর ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবরে গুলশান গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা ‘হত্যা মামলার’ চার্জ গঠন হয়েছে। জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে ৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জ গঠন করা হয়। বিশেষ দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক মামলাটি চার্জ শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। তবে এ মামলায় স্বাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে কি না নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

গুলশান গ্রেনেড হামলার বিস্ফোরক মামলার আসামিদের মধ্যে সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল হুজি-বি শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, দেলোয়ার হোসেন রিপন ও শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অন্য আসামীদের মধ্যে মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জাব্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজা, মফিজুল ইসলাম মফিজ ওরফে অভি ওরফে মহিব উল্যা, মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট কারাগারে রয়েছেন। আর হরকাতুল জিহাদ সদস্য হুমায়ুন কবির হিমু ও মাওলানা মো. তাজ উদ্দিন পলাতক রয়েছেন। 

মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে সিলেটের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট মো. মফুর আলী সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমি এই আদালতের দায়িত্ব নিয়েছি প্রায় ৬ মাস হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আদালতে কোনো স্বাক্ষী হাজির করা যায়নি।’ তিনি বলেন, আদালত স্বাক্ষীদের হাজির হতে বললেও স্বাক্ষীরা আসেন না।’

স্বাক্ষী না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাক্ষীদের অনেকে অস্থানীয় হওয়ায় মামলা নিষ্পত্তির অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তারা অনেকেই স্থানান্তরিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছেন। ঠিকানা বদলে যাওয়ায় আদালত স্বাক্ষীর নামে সমন জারি করলেও সমনের কপি তাদের কাছে পৌঁছানো যায় না। ফলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তির কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না। 

গুলশান গ্রেনেড হামলায় আহত আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব ছাড়ার আগ পর্যন্ত মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন পর্যন্ত মামলার বেশিরভাগ স্বাক্ষীই নেওয়া হয়ে গেছে। সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, আমিসহ যারা হামলার প্রত্যক্ষদর্শী সবাই স্বাক্ষী দিয়েছি। শুধু অফিসিয়াল (পুলিশ, ফরেনসিক রিপোর্টার) স্বাক্ষী যারা ছিলেন তাদের স্বাক্ষী দেওয়া বাকি। 

এই ঘটনার হামলাকারিরা চিহ্নিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, হামলায় জড়িতরা নিজেদের দায় স্বীকার করেছে। তারা কারা সেটাও নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের আশা তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হবে। 

এদিকে দীর্ঘদিনেও মামলার বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন হামলায় আহতরা। গুলশান সেন্টারে হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রায় দু বছর বিছানায় ছিলেন। এখনও তার শরীরে গ্রেনেডের অসংখ্য স্পিøন্টার রয়েছে। যন্ত্রণায় এখনও তাঁকে কুকড়ে যেতে হয় প্রায় সময়। নিজের কষ্টের কথা এক সময় গণমাধ্যমে বললেও এখন এ নিয়ে কোনো কিছু বলতেই চান না। ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, ‘এসব কষ্টের কথা বলে লাভ নেই। প্রতি বছর ওইদিন এলেই গণমাধ্যমের কর্মীরা অনুভূতি জানার চেষ্টা করেন। একইভাবে বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজখবর নেন। এখন এসব বলতে উচ্ছে করে না।’ তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বলেন, ‘একটাই চাওয়া দ্রুত বিচার শেষ হোক এবং দোষীদের শাস্তি দেখে যেতে চাই। 

এএন/আরসি-০৭