গোলাম রব্বানী চৌধুরী
১৬ অক্টোবর , ২০২৫
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষক
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত সিলেট আজ অবহেলা, কাজ সম্পন্নের দীর্ঘসূত্রতা ও অব্যবস্থাপনার এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। সিলেট থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ২৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি বর্তমানে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, অথচ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ রুটে পরিণত হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রায় তিন বছর আগে এই সড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করার একটি মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কয়েক ধাপে কাজ শুরু হলেও আজ পর্যন্ত প্রকল্পে নেই দৃশ্যমান অগ্রগতি। এদিকে মহাসড়কের চলমান ভাঙাচোরা অবস্থায় প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লাখো মানুষ। শুধুমাত্র যানবাহনের জন্য নয়-এই দুরবস্থা বর্তমানে আঘাত করছে দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পর্যটনশিল্প, প্রবাসী যোগাযোগব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকেও।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বর্তমানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খানা-খন্দ, ধুলোয় আচ্ছাদিত বাতাস, যানজট এবং কার্যত অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থা যেন জনজীবনকে পরিণত করেছে এক নিত্যদিনের নরকযন্ত্রণায়। সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন শিশু, বয়স্ক, নারী ও অসুস্থ রোগীরা, যারা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীমুখী হন।
লেখকের পূর্বের কলাম- উপাচার্য পদ : ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে |
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাস্তার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থেকে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আটকে থাকা রোগীর স্বজনদের আহাজারি যেন উন্নয়নের প্রতিশ্রæতির কবরগাঁথা হয়ে রয়ে গেছে। এই রাস্তা আজ নিরাপদ যাতায়াত নয়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেওয়ার এক অনিশ্চিত পথ।
সিলেট বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, লালাখাল, মাধবকুÐ, হাকালুকি হাওর, হিমছড়ি, সাদা পাথরের স্বপ্নিল দৃশ্য-এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রতি বছর লক্ষাধিক পর্যটক সিলেটের পথে রওনা হতেন।
কিন্তু এখন পর্যটকদের আগ্রহ ভাটার টানে। হোটেল-মোটেল বুকিং বাতিল হচ্ছে নিয়মিত, রিসোর্ট-রেস্টুরেন্টে ক্রেতা নেই, গাইড, নৌকা চালক, পরিবহনশ্রমিক সবাই কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এই খাতে যুক্ত অন্তত ৫০ হাজার মানুষ আজ সংকটের মুখে।
পর্যটন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘আমরা করোনার পর কষ্ট করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলাম, কিন্তু এই মহাসড়ক আবার আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।’
এই ক্ষতি শুধু ব্যবসা বা ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। দেশীয় পর্যটনের গতি থেমে গেলে বৈদেশিক পর্যটনের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
সিলেট হচ্ছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রেমিট্যান্স প্রবাহের কেন্দ্র। যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা-বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সিলেটের লাখো প্রবাসী প্রতিবছর দেশে পাঠাচ্ছেন শত শত কোটি টাকা। কিন্তু সেই প্রবাসীরাই যখন দেশে ফিরে আসেন ছুটিতে, তখন স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে আটকে পড়েন মহাসড়কের দুর্ভোগে।
অনেক প্রবাসীর অভিযোগ, ‘যে দেশে টাকা পাঠাই, সেই দেশের মাটিতে ফিরলে ঠিকমতো বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না।’ এমন পরিস্থিতি মানসিকভাবে হতাশাজনক এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রবাসী সমাজের সঙ্গে দেশের সম্পর্কেও ভাঙন ধরাতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে এ নিয়ে সভা-সেমিনার এমনকি আন্দোলন শুরু করেছেন প্রবাসীরা। তাছাড়া রেমিট্যান্স বন্ধ করে দেওয়ার মতো হুমকির কথাও শোনা যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কল্যাণ বয়ে আনবে না।
সিলেট বিভাগের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজসহ আরও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা-সিলেট রুটটি একমাত্র কার্যকর যাতায়াত মাধ্যম। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদেশি শিক্ষার্থীও রয়েছেন। অথচ এই মহাসড়ক আজ তাদের কাছে ভয়াবহ মানসিক চাপ, নিরাপত্তাহীনতা ও একাডেমিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছুটির পর ক্যাম্পাসে ফিরতে গিয়ে কোথাও আটকে পড়া, ১৪-১৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে ক্লান্ত শরীরে ক্লাসে ঢোকা, সময়মতো পরীক্ষা দিতে না পারা-এগুলো আজ তাদের নিত্যকার অভিজ্ঞতা।
এমন অবস্থায় অনেক অভিভাবক সন্তানদের পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন, কেউ কেউ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলির কথা ভাবছেন, আবার কেউ উচ্চশিক্ষার ইচ্ছাই ত্যাগ করছেন।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এই দীর্ঘসূত্রতা ও বেহাল দশার কারণে পণ্যের পরিবহন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০-৪০%। ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। কাঁচামাল, ফলমূল, চাল, তেল, মাছ-সব পণ্যের দাম সিলেট অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘রাস্তায় গাড়ি আটকে গেলে সময়ও যায়, তেলও যায়। সেই খরচ আবার ভোক্তার ঘাড়েই পড়ে।’
প্রকল্পটি একাধিক দফায় সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। জায়গা অধিগ্রহণ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন, অর্থ ছাড়, প্রকৌশল তদারকি-সব জায়গায় বারবার স্থবিরতা ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা গেছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে জনগণের যে আস্থা ছিল, তাও এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু একটি অঞ্চলের এত গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক বছরের পর বছর ধরে অসমাপ্ত থাকা কেবল দুঃখজনক নয়, বরং রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতার ওপর এক বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ ট্রেন সার্ভিস, বিকল্প রুট ও তদারকি জোরদার করা হোক। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রকল্পের কাজ যত দ্রæতই করা হোক না কেন, বাস্তবায়নে আরও সময় লাগবে। সেই সময় পর্যন্ত কিছু জরুরি ও বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
নির্দিষ্ট দাবিসমূহ :
১. ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সংস্কার ও ৬ লেন প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। ২. প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, তদারকি ও দ্রæত অর্থ ছাড় নিশ্চিত করতে হবে। ৩. সিলেট-ঢাকা রুটে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করতে হবে-বিশেষ করে শিক্ষার্থী, রোগী, প্রবাসী ও পর্যটকদের জন্য। ৪. জরুরি রোগী পরিবহনে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স করিডোর/সাপোর্ট রুট চালু করা হোক। ৫. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মালবাহী পরিবহনের বিকল্প রুট নিশ্চিত করা হোক (যেমন: ট্রেন, নৌপথ)। ৬. পর্যটন শিল্পের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রণোদনা প্যাকেজ ও পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি।
সিলেট শুধু একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়- এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রবাসী সম্পদের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এই অঞ্চলের জনগণ আজ যেভাবে প্রতিনিয়ত অবহেলা, দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রশাসনিক গাফিলতির বলি হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
যদি সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে কেবল একটি অঞ্চলের ক্ষতি নয়-পুরো দেশ এর খেসারত দেবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে। তাই সরকার, জনপ্রতিনিধি, নীতিনির্ধারক, প্রশাসনসহ সব পক্ষের প্রতি অনুরোধ- আপনারা প্রজেক্ট পেপারে নয়, উন্নয়ন দেখান বাস্তবে সড়কে, মানুষের জীবনে। নতুবা সিলেটের মানুষ আন্দোলনে রাজপথে নামলে এর পরিণতি কারও জন্যই ভালো হবে না। অতীত ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে।