গোলাম রব্বানী চৌধুরী
০৯ অক্টোবর , ২০২৫
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষক
একসময় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। কিন্তু আজ, সেই একই প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) পদ ঘিরেই ঘনঘন সৃষ্টি হচ্ছে বিতর্ক, আন্দোলন ও প্রশ্নবোধক পরিস্থিতি। প্রশ্ন ওঠে-দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ আজ এতটা বিতর্কিত হয়ে উঠলো কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে দেখা যায়, এক সময় উপাচার্য ছিলেন এমন সব বিদ্বান, নীতিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মানুষ, তাঁদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সত্যিকার অর্থেই চিন্তা ও মননচর্চার কেন্দ্র।
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় আমরা প্রায়শই দেখছি, উপাচার্যদের ঘিরে-নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক পক্ষপাত, ছাত্র সংগঠনের তোষণ, শিক্ষার্থী দমনের অভিযোগ, প্রশাসনিক দুর্নীতি এসব অভিযোগ যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখকের পূর্বের কলাম- সিলেট চেম্বার অব কমার্স : দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দরকার |
বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে রাজনৈতিক আনুগত্যের গুরুত্ব। অনেক সময় দেখা যায়, একজন শিক্ষকের গবেষণা, প্রশাসনিক দক্ষতা কিংবা শিক্ষা-দর্শনের চেয়ে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান বা ‘ঘনিষ্ঠতা’কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ফলে উপাচার্য যখন দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকে না বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি, বরং থাকে তাকে নিয়োগদানকারী ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর প্রতি। এ অবস্থা তাকে বাধ্য করে নিরপেক্ষতার বদলে পক্ষপাতিত্বে।
একজন উপাচার্য শুধু প্রশাসনিক প্রধান নন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক নেতৃত্বও দেন। তাঁর সিদ্ধান্তে শিক্ষার গুণগত মান নির্ধারিত হয়, তৈরি হয় গবেষণার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মুক্ত ও সহনশীল একাডেমিক পরিবেশ।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি-উপাচার্য অনেক সময় নিজের অবস্থান রক্ষায় ছাত্রসংগঠন বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করছেন। অনেক সময় সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় উপাচার্য হয়ে পড়ছেন বিতর্কিত, এমনকি অনাস্থার প্রতীক।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাক্ষেত্রে সক্রিয়, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে এই রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিভাগীয় প্রধান নির্বাচন,এমনকি ক্লাসরুমের পাঠদান-সব কিছুতেই ছায়া ফেলছে দলীয় রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর নিরপেক্ষ থাকছে না। বরং অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসনই রাজনৈতিক সংগঠনের ‘পৃষ্ঠপোষক’ হয়ে কাজ করছে।
এতে শিক্ষার মান পড়ছে, ছাত্র-শিক্ষক বিভক্তি বাড়ছে। এই পরিস্থিতির পরিণতি কিন্তু ভয়াবহ। এতে মেধাবী শিক্ষকরা পিছিয়ে যাচ্ছেন, যোগ্য শিক্ষার্থীরা ন্যায্য সুযোগ পাচ্ছেন না, গবেষণার মান হ্রাস পাচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে উদ্বেগ, ভয় এবং অস্থিরতা বাড়ছে।
এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র হওয়ার কথা, সেখানে এখন দলীয় আনুগত্যই মাপকাঠি হয়ে উঠেছে-এটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
সমাধানের পথ কী?
এতোসব সংকটের পরও আশার কথা-সমাধান সম্ভব। তবে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক সংস্কার এবং সমাজের সক্রিয় চাপ।
১. স্বচ্ছ ও স্বাধীন নিয়োগ প্রক্রিয়া : একটি স্বতন্ত্র ও অরাজনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা নিরপেক্ষভাবে উপাচার্য ও শীর্ষ পদে নিয়োগ সুপারিশ করবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত মে মাসে শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্বে ভিসি ও প্রো-ভিসি নিয়োগে একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু এখনও এই কমিটির সুপারিশ পাওয়া যায়নি বা চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানা যায়নি। তাই দ্রæত বিষয়টির একটি নীতিমালা তৈরি প্রয়োজন।
২. বিশ্ববিদ্যালয় আইন হালনাগাদ : বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনেকটাই পুরনো ও অস্পষ্ট। আইন হালনাগাদ করে উপাচার্য ও প্রশাসনিক দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি ও সীমারেখা নির্ধারণ করতে হবে।
৩. শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস : ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু তা যেন প্রশাসন বা শিক্ষকের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে না পারে-এমন সতর্ক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
৪. জবাবদিহিমূলক প্রশাসন : প্রতিটি নিয়োগ, খরচ, সিদ্ধান্তের জন্য প্রশাসনকে ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকদের সামনে জবাবদিহি করতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলেই আস্থা ফিরবে।
শেষ যে কথাটি বলতে চাই- বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতির চেতনা গঠনের কারখানা। এই কারখানার প্রধান পরিচালক হলেন উপাচার্য। তিনি যদি নিজেই বিতর্কিত, স্বচ্ছতাবিবর্জিত ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হন, তাহলে পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।
‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ একদিন শুধু ইতিহাসের বইয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবে নয়-এমন পরিণতি আমরা কেউ চাই না।
তাই এখনই সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপরাজনীতি থেকে মুক্ত করে, মেধা ও নৈতিকতাকে নেতৃত্বে আনার। তবেই গড়ে উঠবে একটি আলোকিত, সচেতন ও মানবিক বাংলাদেশ।
এএফ/০৫