গোলাম রব্বানী চৌধুরী
০৪ অক্টোবর , ২০২৫
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষক
সিলেট একটি বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রবাসীবান্ধব নগর। এই অঞ্চলের অর্থনীতি একদিকে কৃষি ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে প্রবাসীদের রেমিটেন্স এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা (SME) খাতের উন্নতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা যে সংগঠনের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রত্যাশা করেন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (SCCI) সেই প্রতিষ্ঠানটির কার্যকরতা নিয়ে প্রশ্ন ও অসন্তোষ বেড়েই চলেছে।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিলেট চেম্বার অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী। এটি বহু বছর ধরে ব্যবসায়িক লাইসেন্স প্রদান, বাণিজ্য উন্নয়ন, সরকারি সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু আজকের ব্যবসায়িক বাস্তবতা ১০ বছর আগের মতো নেই। আজ SME, স্টার্টআপ, ই-কমার্স, ফিনটেক, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এগুলো আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চেম্বার কি এসব খাতে বাস্তব কোনো সহায়তা বা নীতিগত দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছে?
সিলেটের ছোট-বড় অসংখ্য ব্যবসায়ী, বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের দোকানদার, কাঁচা বাজার ব্যবসায়ী, হকার কিংবা ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে চেম্বার নিয়ে কিছু অভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন-ট্রেড লাইসেন্স ও অন্যান্য সেবা পেতে জটিলতা, সময়মতো তথ্য বা নির্দেশনার অভাব, জরুরি সমস্যা বা দরকারে চেম্বার থেকে সহায়তা না পাওয়া, গুটি কয়েক ব্যবসায়ীর প্রাধান্য, সাধারণ সদস্যদের উপেক্ষা, সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি এবং কার্যত অংশগ্রহণের সুযোগ কম, এই অভিযোগগুলো দীর্ঘদিনের, কিন্তু বাস্তব কোনো সংস্কার উদ্যোগ আজও চোখে পড়েনি।
২০২৫ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিলেট চেম্বার পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হবে ২০২৬ ও ২০২৭ সালের জন্য। এই নির্বাচন শুধুমাত্র নেতৃত্ব নির্বাচন নয়। এটি হবে ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণের মঞ্চ।
সাধারণ ভোটার বা ব্যবসায়ীদের এখন আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত। এই নির্বাচন কি শুধু মুখচেনা লোকদের জয়যুক্ত করার উৎসব, নাকি সত্যিকারের সমস্যা সমাধানের যোগ্য নেতৃত্ব তুলে ধরার সুযোগ?
নেতৃত্বে এমন কাউকে দরকার, যিনি-ব্যবসায়ীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে নীতিনির্ধারণী স্তরে কথা বলবেন, ডিজিটাল ও টেক-সক্ষম চেম্বার গঠনে আগ্রহী হবেন, ফিনান্স, কর, আমদানি-রপ্তানি, উদ্যোক্তা উন্নয়নে কর্মশালা, ট্রেনিং, আর্থিক সহায়তা নিয়ে আসবেন, শুধু বড় ব্যবসায়ীদের নয়, প্রান্তিক ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের কথা বলবেন, চেম্বারকে ‘চেম্বার’ থেকে ‘ব্যবসায়িক সহায়তা কেন্দ্র’তে রূপান্তর করবেন।
এই চেম্বারকে আরও কার্যকর ও ব্যবসায়ী বান্ধব করতে নিচের সুপারিশগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। যেমন-ট্রেড লাইসেন্স, রিনিউয়াল, ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা, সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় ও অভিযোগ সমাধানে নিয়মিত আলোচনা সভা, চেম্বার অ্যাকশন ডেস্ক, জরুরি সমস্যা সমাধানে একটি হটলাইন ও রেসপন্স টিম, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা সহায়তা সেল, যোগাযোগ ও ট্রান্সপারেন্সি, চেম্বার বোডের সভার সিদ্ধান্ত ও কাজের অগ্রগতি সদস্যদের সামনে উপস্থাপন, এবং সিলের্টের প্রবাসীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে চেম্বারকে সক্রিয় করা।
প্রকৃত নেতৃত্ব তখনই সফল হয় যখন তা সময়, সমস্যা ও সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। সিলেটের ব্যবসায়ী সমাজের এখন সময় এসেছে পুরোনো ধারা থেকে বের হয়ে চেম্বারকে নতুন আঙ্গিকে ভাবার।
যারা এই নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন, তাদের মধ্যে থেকে দায়িত্ববান, অভিজ্ঞ ও প্রগতিশীল নেতৃত্ব বেছে নেওয়াই হতে পারে ভবিষ্যতের জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
চেম্বার শুধু একটি পদ নয়, এটি ব্যবসায়ী সমাজের মুখপাত্র। এই মুখপাত্র যেন আমাদের প্রত্যাশা ও সমস্যার যথাযথ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারে এটাই সবার কাম্য।
এএফ/০৩