Cinque Terre

মো. সামিউল আহসান তালুকদার

১৭ জুন , ২০২০


সহযোগী অধ্যাপক, ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার ল্যাব, কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় 

 


কোভিড-১৯ : খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় করণীয়

বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রথম করোনা ভাইরাস সনাক্ত করা হয় ৮ মার্চ। ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান এবং ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ নিবন্ধটি লেখার সময় অর্থাৎ ১৬ জুন পর্যন্ত ১০০ দিনে মোট আক্রান্ত হয়েছে ৯৪ হাজার ৪ শত ৮১ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ১ হাজার ২৬২ জন। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে এত দীর্ঘ সময়ের জন্য গৃহবন্দী থাকতে হবে বাংলাদেশের কোন মানুষ সেটি অনুমান করতে না পারলেও এই মহামারীর প্রভাব মোকাবেলার জন্য যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী অবশ্য করণীয় কৌশল সম্পর্কে সবকিছু আমরা নির্ধারণ করতে না পারি, তবে অবশম্ভাবী জরুরি খাদ্য অবস্থা  যে আসন্ন, সেটি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। বিষয়টি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এর অতি সম্প্রতি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ঠ নীতিনির্ধারনী বার্তায় আরও স্পস্ট হয়েছে।

মহামরীর কারণে ক্রমাগতভাবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও হুমকির মুখে পড়ছে। জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব’ শীর্ষক রিপোর্টটিতে বলা হয় বিশে^র জনসংখ্যার ৭.৮ বিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানোর জন্য বিশে^ পর্যাপ্ত পরিমানে খাদ্য থাকলেও প্রায় ৮২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৪৪ মিলিয়ন শিশুর শারিরীক বিকাশ ও বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জিডিপি’র প্রতি শতাংশ পয়েন্ট পতনে প্রায় ০.৭ মিলিয়ন শিশুর শারিরীক বিকাশ ও বৃদ্ধি ব্যহত হয়। অনুমান করা হচ্ছে, এই মহামরীর কারণে বিশ্বের প্রায় ৪৯ মিলিয়ন লোক চরম দারিদ্র্য (দৈনিক আয় ১.২৫ ডলার বা ১০৭ টাকা বা তার কম) এর মধ্যে পড়তে পারে। সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছে, বাংলাদেশে এ বছর আয় বৈষম্য সর্বকালের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে এবং দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ বাড়তে পারে। ফলে তীব্রভাবে খাদ্য বা পুষ্টি নিরাপত্তাহীন লোকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে আরও বৃদ্ধি পাবে।

জাতিসংঘের রিপোর্টটিতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার উপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় তিনটি পদক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ হলো, তীব্র ঝঁকিপূর্ণদের বাঁচাতে জীবন ও জীবিকা সচলকরণ। অর্থাৎ ঝুঁকিপূর্ণ ও  সংবেদনশীল শ্রেণিগুলির মানবিক খাদ্য, জীবিকা এবং পুষ্টি সহায়তা সংরক্ষণ করা। এর পাশাপাশি, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ ও বন্টন এবং পরিবহন ব্যবস্থাকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা করা। এছাড়াও, হালনাগাদ খাদ্য নিরাপত্তা মনিটরিং সিস্টেম সম্প্রসারণ করা, ত্রাণ ও প্রণোদনা প্যাকেজগুলি ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা এবং বাজারের জন্য সহায়তা বাড়ানোসহ খাদ্য ব্যবস্থার অবিচ্ছিন্ন কর্মকান্ড নিশ্চত করতে বাণিজ্য করিডোরগুলি উন্মক্ত রাখতে বলা হয়েছে। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বিগ্ন ঘটলে খাদ্য সমৃদ্ধ দেশেও খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা ব্যহত হতে পারে। আমাদের দেশে এবছর বোরোধানের বাম্পার ফলন এবং কৃষকের নিরাপদে সংগ্রহ একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন মজুদ থেকে সরকার যদি পর্যপ্ত ধান মজুদ না করে তবে প্রান্তিক জনগোষ্টির খাদ্যনিরাপত্তা ব্যহত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা থেকেই যাবে। সম্প্রতি এক ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে যে, লক্ষ্যমাত্রা ৮ লক্ষ টনের মধ্যে গত ২৮ এপ্রিল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৭ শত ৭৫ টন বোরো ধান যা লক্ষমাত্রার মাত্র এক শতাংশেরও কম। অন্যদিকে, মিল মালিকদের কাছ থেকে গত ৭ই মে সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে ১০ লক্ষ টন যা লক্ষ্যমাত্রার ৬ শতাংশ মাত্র। করোনা ভাইরাসের আকস্মিক ছোবলে কর্মহীন হয়ে পড়া স্বল্প আয়ের অনাহার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্টির মধ্যে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে পর্যাপ্ত ধান, চালসহ অন্যান্য খাদ্য মজুদ করা অত্যন্ত জুরুরি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এ বছরের ৩ জুন গত বছরের তুলনায় চালের মজুদ ২৯ শতাংশ কমেছে। একই দিনে অন্যান্য খাদ্যের মজুদ ১৬ শতাংশ কমেছে। যা আগামী দিনগুলোতে ক্রমাগত ভাবে চালসহ অন্যান্য খাদ্যের মজুদ আরও হ্রাস পাবে। সরকারি মজুদ না থাকার কারণে সম্প্রতি পেঁয়াজসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রবের কল্পানাতীত মূল্যবৃদ্ধি আমাদের সবারই জানা।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো, সামাজিক পুষ্টি নিরাপত্তা সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারকরণ। অর্থাৎ অল্প বয়স্ক শিশু, গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলা,  বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি অথবা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সরাসরি জিও বা এনজিও কর্মসূচীর মাধ্যমে সুষম খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা স্কিমগুলি গ্রহণ এবং তা সম্প্রসারিত করা। বাংলাদেশে ১৬.৭ মিলিয়ন বসতবাড়ির অধীনে প্রায় ০.৩ মিলিয়ন ভূমি রয়েছে, যার পরিমাণ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে। বসতবাড়িগুলোতে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি বনায়ন কাঠামোর অধীনে ফলজ, বনজ বৃক্ষের সঙ্গে শাকসবজি, ঔষধি গাছ, মসলা জাতীয় ফসলসহ উচ্চ মূল্যের ফসল যেমন গোলমরিচ, এলাচ প্রভৃতি চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ জীবিকা উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বন বিভাগের অধীন চলমান সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে আরও বেগবান করতে হবে।

তৃতীয় পদক্ষেপ হলো, টেকসই ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৪ শতাংশ মিথেনসহ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ২৯ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা অবদান রাখে। ফলে, কৃষি একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় অবদানের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কোভিড-১৯ মহামারীর মাধ্যমে প্রকৃতি আমাদের একটি পরিষ্কার বার্তা প্রেরণ করেছে। তাই, প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে রূপান্তর করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি কাঠামোর প্রবর্তনের জন্য বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সিলেট অঞ্চলে আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মাস্টার্স শিক্ষার্থী তার থিসিসে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষির সম্প্রসারণে তিনটি পন্থা উল্লেখ করেছে। পন্থাগুলো হলো, স্বল্প মেয়াদী তথ্য-স্থানান্তর পন্থা স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী উদ্যোক্তা সৃষ্টি পন্থা এবং দীর্ঘ মেয়াদী নীতিগত পন্থা। উদাহরণস্বররূপ, তথ্য-স্থানান্তর পন্থায় কৃষকদের তথ্য, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষি বনায়ন প্রযুক্তি, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ, উলম্ব নিষ্কাশন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি, এডব্লিউডি পদ্ধতিতে সেচ, গুটি ইউরিয়া, সর্জান ও ভাসমান পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন, স্যান্ডবার  পদ্ধতিতে চরাঞ্চলে ফসল উৎপাদন প্রভৃতি জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। উদ্যোক্তা সৃষ্টি পন্থায় আর্থিক প্রনোদনার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে অপার সম্ভামনাময় বানিজ্যিকভাবে বায়োচার ও ভার্মিকম্পোস্ট জাতীয় জৈব সার, স্মাট চুল্লি, মৌচাষ প্রভৃতি জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তির উদ্যোক্তা সৃষ্টির পাশাপাশি সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। নীতিগত পন্থায় রোগ-বালাই ও দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবস্থা, কৃষির বিগ ডাটা সেন্টার, শূন্য কার্বন প্রনোদনা, কৃষি বীমা প্রভৃতি সম্পর্কে মাঠ পর্য়ায়ের অভিঙ্গতা ও গবেষণালব্ধ ফল নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সর্বপরি, জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষকের জীবন-জীবিকার উন্নতি, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্যকে অক্ষুন্ন রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষমতা সৃষ্টি হবে।

মহামারী শেষে নতুন স্বাভাবিক পৃথিবীর উদয় হবে। পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থার সঙ্গে তার খুব বেশি মিল থাকবে না। সে নতুন স্বাভাবিক পৃথিবী হবে নৈতিকভাবে বলিয়মান সৎ, দক্ষ, প্রজ্ঞাবান, স্ব-দায়বদ্ধ ও পরিশ্রমী মানুষদের। নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সামর্থ্য থাকলেই যেমন একটি দেশ অন্য দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে পারবে না। তেমনি ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রয় ক্ষমতা নির্ভর ভোগ প্রথাও চলবে না। তাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। কোভিড-১৯ মহামারীর সামগ্রিক প্রভাব মোকাবেলায় জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি ব্যবস্থায় রুপান্তরের পাশাপাশি জলবায়ু সহিষ্ণু জীবনধারাও জরুরি।