Cinque Terre

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

৩০ এপ্রিল , ২০২৫


সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

[email protected]
আর্থরাজনীতির সফল মানুষ আবুল মাল আবদুল মুহিত


আজ আবুল মাল আবদুল মুহিতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। একটি পরিতৃপ্ত, কর্মবহুল ও বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি মারা যান। দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এ মানুষটি বাংলাদেশের উন্মেষ ও রূপান্তরের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ ইত্যাদি নানা পরিচয়ে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। সর্বোপরী তিনি ছিলেন উন্মত রুচির এক উদার মনের পরিশিলীত, প্রগতিকামী মানবিক মানুষ। 

একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ও সমৃদ্ধিতে তিনি এক রূপান্তরের নায়ক। ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন এই আলোকিত গুণীজন ছিলেন একজন ন্যায়নিষ্ঠ,সজ্জন চিৎপ্রকর্ষবিদ। অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী এক প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন তিনি । সদা হাস্যোজ্জ্বল কর্মযোগী, ধ্যানী, ধীমান এই মানুষটি ছিলেন স্পষ্টবাদী। সরলতা ও সাহসিকতা ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ গুণ। সত্যকথনে তিনি কুন্ঠাবোধ করতেন না।

১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং মা  সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী। দুইজনই রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন। সংস্কৃতিমান পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা মুহিত  কৈশোরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। শিশু কিশোর সংগঠন 'মুকুল ফৌজ' গঠন করে নেমে পড়েন সৃজনশীল চর্চায়। আটাশি বছর বয়সে তার সৃজনশীল চর্চা থেমে থাকেনি। অসুস্থ হওয়ার  আগ পর্যন্ত তিনি লিখেছেন আত্মজীবনী। দেশের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে ব্যক্ত করেছেন নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ মতামত। 

আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে স্কুল ছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ  থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। চাকুরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস-এ (সিএসপি) যোগ দেওয়ার পর জনাব মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রিয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন। তবে এই দায়িত্ব গ্রহণ না করে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকোনোমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এখন পর্যন্ত তিনি একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এ পদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১- এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

১৯৮১ সালে চাকরি  থেকে  স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি সার্বক্ষনিক দেশে অবস্থান করে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে ভুমিকা রাখতে শুরু করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের সুশীল সমাজের একজন অগ্রনী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভুত হন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনে তিনি একজন পথিকৃত এবং বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ২০০১ সালের অগাস্টে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট ১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে সিলেট ১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তিনি নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। ২০১৪ সালে সিলেট ১ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি আবারও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে আর নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের ঘোষণায়ও তিনি ব্যতিক্রম। 

একজন লেখক হিসেবেও জনাব মুহিত খ্যাতিমান। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিষয়ে তাঁর 'জেলায় জেলায় সরকার' একটি আকর গ্রন্থ। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মহকুমা গুলোকে জেলায় রূপান্তর এবং গণতান্ত্রিক জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রশাসনিক প্রতিবেদন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। 

বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব আবুল মাল আবদুল মুহিত  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে তার গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করতেন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হবে এ নিয়ে ছিল তাঁর গভীর আত্মবিশ্বাস। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে ছিল তাঁর গভীর উৎকন্ঠা। প্রতিহিংসার রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। প্রচলিত রাজনীতির ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন।  

আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথাগত রাজনীতির পথে না হেঁটে জাতির বিকাশমান ধারাকে অগ্রবর্তী করেছেন। ঐতিহ্যের পরম্পরা ধারণ করে দলীয় রাজনীতি করেও  হয়ে ওঠেছেন সর্বদলীয় অভিভাবক। পরিশীলিত বুদ্ধিবৃত্তিক মন ও রুচিশীল সাদামনের মানুষ হিসেবে হয়েছেন জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির সারথি। একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ও সমৃদ্ধিতে তিনি এক রূপান্তরের নায়ক।  অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর বড় সাফল্য হলো তাঁর আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার কয়েক গুণ বেড়েছে। তাঁর  আমলে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বেড়েছে, অর্থনীতির ভিত সুদৃঢ় হয়েছে। আবার ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা কমাতে না পারা, শেয়ারবাজারে ধস থামাতে না পারা নিয়ে তাঁর আক্ষেপও ছিল।

আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ আবুল মাল আবদুল মুহিতের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। মন্ত্রিত্ব, সরকারি-বেসরকারি পদের বাইরেও তিনি সামাজিক দায়বোধ থেকে সম্পৃক্ত থাকতেন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেকে সদা যুক্ত রেখেছেন আপন মহিমায়। দলীয় সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দিতেন না তিনি। প্রজ্ঞাবান এই মানুষটির স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। ইতিহাস চর্চা আর অজানা তথ্য জানতে তিনি ছিলেন সদা আগ্রহী। গুণীজনদের মূল্যায়ন করতেন যথাযথ উপমা আর অনবদ্য শব্দচয়নে। কর্তব্য কর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত থাকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। সংস্কৃতি কর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য ছিল নিবিড় ও গভীর। বর্ণিল জীবনের অধিকারী এই মানুষ চলে গেছেন প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তিতে, তাঁর  সাধনায়। আর্থরাজনীতির সফল মানুষ আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।