Cinque Terre

দীপংকর মোহান্ত

২০ মে , ২০২১


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


বিস্মৃতির ১৯২১ : ‘মুল্লুকে চল্’ অভিযানের শতবর্ষ

চীনের একচেটিয়া চা ব্যবসার বাজার ধরতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮৮ সালে ভারতে চা-গাছ অনুসন্ধানের জন্য পত্র চালাচালি শুরু করে দেয়। সিলেট জেলা কোম্পানির অধিকারে চলে গেলে তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দুর্ভেদ্য পাহাড় দখলে নেয় এবং চা-গাছ শনাক্তের চেষ্টা চালায়। ১৮২৩ সালে রবার্ট ব্রুস সাদিয়া-লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে চা-গাছ আবিষ্কারের ফলে ঔপনিবেশিক বণিকদের কাছে সিলেট-আসাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৯ সালে ‘আসাম চা-কোম্পানি’র মাধ্যমে চা-আবাদের সূচনা ঘটে। অন্যদিকে ১৮৫৬ সালে তৎকালীন সিলেট জেলার এগারোসতি পরগনায় মোহাম্মদ ওয়ারিশ  পুনরায় চা-গাছ আবিষ্কার করেন। ফলে সিলেটের পাহাড়ে চা-আবাদের হিড়িক পড়ে যায়। বাংলায় নীল চাষের ধুসর বেলায় কোম্পানির কর্মকর্তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী লাভজনক চা-ব্যবসায় সবাই পুঁজি  বিনিয়োগ করতে থাকে। 

সিলেট-আসামের অঢেল ভূমি ‘West Land Settlement Rulea of 6th March 1438-আইনে প্রথমে বরাদ্দ শুরু হয়। পরে ২৩ অক্টোবর ১৮৫৪ সালে এই আইন আরো সহজ করে দীর্ঘ মেয়াদি ভূমি লিজ দেওয়া আরম্ভ করে। এই আইনেই ১৮৫৬ সালে সিলেটের জৈন্তা পরগণার ‘নর্থ সিলেট টি কোম্পানির মালনিছাড় চা বাগানের জন্য ১৮৫৭ একর ভূমি লিজ দেওয়া হয়েছিল। ১৮৫৭ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সিলেটে ২৩ টি চা-বাগানের পত্তন হয়। কিন্তু তখন নবগঠিত বাগানে শ্রমিকের যোগান ছিল খুব কম। 

কোম্পানি চা-বাগানের তৈরিতে উৎসাহিত  করলেও প্রথম সংকট দেখা দেয় চা-শ্রমিক সংগ্রহ নিয়ে। শ্বাপদসংকুল ঘন-বনাঞ্চল পরিষ্কার করা ছিল জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পাহাড়ে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীজন চা-আবাদ সন্দেহের চোখে দেখে। তারা শ্রমিক হতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে সিলেটের স্থানীয় লোকজন এই কাজে যোগদান করেনি। প্রথমদিকে চা-বাগান তৈরির কাজে পটু সামান্য চীনা শ্রমিকদের সংগ্রহ করা হলে বিষয়টি অলাভজনক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ তাদের মজুরির পরিমান ছিল বেশি। অগত্যা ঔপনিবেশিকদের চোখ পড়ে ভারতের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের বিপন্ন কৃষকদের ওপর। সমকালে ঔপনিবেশিক সরকারর মরিসাশ অঞ্চলে ভাগ্যহীন লোক পাঠিয়ে লাভের মুখ দেখেছিল। তারা গবির অঞ্চলের অসহায় মানুষকে প্রথম টার্গেট করে।  ব্রিটিশ টি প্ল্যান্টার্সরা চা-শ্রমিক সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দালাল সৃষ্টি করে, যারা ‘আড়কাঠি’ [আড়কাঠিয়া] নামে পরিচিতি পায়। ‘আড়কাঠি’রা নানা ছলনায় বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, রাঁচি, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ,  ঝাড়খণ্ড, ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগণা প্রভৃতি এলাকার অভুক্ত গরীব কৃষকদের গিয়ে অলিক গল্প করতো যে ‘শ্রীহট্ট-আসাম’-এর জঙ্গলে টাকার গাছ পাওয়া গেছেওখানে সবাই যাচ্ছে ও টাক আনছে। দালাদরা গল্প করতো যে, আসামে জঙ্গলে ‘টাকার গাছে’ ঝাড়া দিতে হয়‘গাছ হেংলানেছেপয়সা মিলেগা’। 

কল্প-কথার ওপর বিশ্বাস রেখে গরিব মানুষ সুখি জীবনের আশায় অনিশ্চিত পথে তারা রওয়ানা দেয়। আবার অনেককে পাচার করা হয়। গবেষক উমানন্দ পোকান দেখিয়েছেন যে, আঠারো শতকের ষাটের দশকে ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে বড় নৌকায় আসামের জঙ্গলে প্রথম শ্রমিকদের চালান দেওয়া হয়। উত্থাল নদী পথে অর্ধেক লোক মারা যায়। কিন্তু এই খবর হতভাগ্যদের বাড়িতে কখনো দেওয়া হতো না। এভাবে অনেক লোক মরতে-মরতে কিছু টিকে থাকতো। শ্রমিক সংগ্রহের জন্য ক্রমে নৌকা, স্টিমার জাহাজ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পথে শ্রমিক মারা যাওয়া কমেনি। আবার তারা আসাম-সিলেটের জঙ্গলে প্রবেশ করলেও ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ডায়রিয় ও জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণে অনেকে প্রাণ হারায়। আঠারো শতকের শেষ দিকে চাপের মুখে সরকার আইন করে যে, শ্রমিকদের বুঝিয়ে ও চুক্তির মাধ্যমে আনতে হবে। কিন্তু নিরক্ষর লোকজন কোথায় টিপসই করছে তা বুঝতো না। তারা বুঝতো যে, ‘গিরমিট’ আইন হয়েছে। অর্থাৎ এগ্রিমেন্ট হয়েছে। এই চুক্তিটি কৌশলে চিরদাসত্বের মতো ছিল। শ্রমিকরা তাঁর জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার পথ ছিনত না। এভাবে অমানবিক কায়দায় ১৮৭১ সাল পর্যন্ত কেবল বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বাগানে ৫৪,৩২৬ জন শ্রমিক সংগ্রহ করেছিল। ১৮৯০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭১,৯৫০ জন [১৯০০ সাল পর্যন্তÑ ১,৪৯,৯৫০ জনে দাঁড়ায়। চোরাপথে চালান দেওয়া এই হিসেবের বাহিরে]।

প্রথমদিকে কৃষি কাজে অভ্যস্ত এই শ্রমিকদের কৌশলে ‘মদ’-এর নেশা ধরিয়ে উন্মাদের মতো রাখা হতো। অবাধ্য শ্রমিকদের জন্য ছিল চাবুক। বাগানে গড়ে ওঠে ‘গারদ’ নামের জেল। অর্থাৎ কাজে অনিচ্ছুক ও অবাদ্য শ্রমিকদের একটা ছোট ঘরে আটকে রেখে ‘সোজা’ করা হয়। তাছাড়াও বাগানে ‘চোরা লাইন’ ছিল। যেখানে বিদ্রোহী শ্রমিকদের গোপনে আটকে রাখা হতো। মজুরি ছিল নাম মাত্র। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা হয়। বাগানে ম্যানেজার ছিল সর্বেসর্বাÑ ‘মাইবাপ’। তিনি আইন ইচ্ছে মতো শাস্তি ক্ষমতা ছিল। অন্যদিকে শ্রমিকরা যেন টাকা সঞ্চয় যাতে না করতে পারে তার ব্যবস্থা ছিল ঔপরিবেশিকদের মাথায়। আশাহত শ্রমিকদের বাগান থেকে পালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। শ্রমিকদের লোকালয়ে/বাজারে যাওয়া যেমন নিষিদ্ধ ছিল; তেমনি বস্তিবাসী লোকদের বাগানের প্রবেশাধিকার ছিল না। প্রতি বাগানের জন্য ছিল আলাদা-আলাদা ‘বাগানী’ টাকা। এই টাকা শুধু একটা বাগানে প্রচলিত ছিল। অন্য বাগানে গেলে সেই শ্রমিক টাকার মাধ্যমে ধরা পড়ে যেত। শ্রমিক লাইনে সকাল-সন্ধ্যা ‘গনতি’র [গণনা] প্রচলন ছিল। এই পরিবেশে ও কঠোরতায় শ্রমিকদের মধ্যে একতা ও ঐক্য গড়ে ওঠেনি। অথচ তারা মনে-মনে জন্মমাটিতে ফিরৎ যাওয়ার অনেক চেষ্টা করে; কিন্তু  ‘গিরমিটে’র জন্য পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না।

চা-শ্রমিকরা কোনো রাজনীতি করেনি। তাদের দুর্দশার কথা সভ্য জগতে জানায় ব্রাহ্মধর্মের কয়েকজন পরিভ্রাজক। তারা ধর্ম প্রচারের আড়ালে শ্রমিকদের সচেতন করার চেষ্টা চালায়কিন্তু কার্যত সম্ভব হয়নি। তখনো অনেক বাগানে শ্রমিকরা বিদ্রোহী হয়েছেকিন্তু সবুজ টিলার বাইরে সে আওয়াজ যায়নি। শ্রমিকদের ওপর স্বদেশী আন্দোলনের কিছু প্রভাব চা বাগানে পড়েছিল। ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের আগের রাজনৈতিক কর্মীরা বাগানে প্রবেশ করতে পারেনি। বাগানের কয়েকজন সচেতন পুরোহিত বিভিন্ন কৌশলে চা-শ্রমিকদের মধ্যে গান্ধী ও অসহযোগের খবর গোপনে প্রচার করে। অসংগঠিত চা-শ্রমিকরা তখন মহাত্মা গান্ধীকে তাদের ‘ত্রাণ’ বা উদ্ধার কর্তা হিসেবে মানস কল্পনায় স্থান দেয়।

১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সুযোগে কিছু শ্রমিক বাগান ছেড়ে স্ব-ভূমে ফিরে যাওয়াকে উত্তম সময় মনে করেছিল। বাইরের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রভাবে অনেক চা-বাগানের শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবী-দাওয়া জানিয়ে ধর্মঘট শুরু হয়। ১ মে ধলাই ভ্যালির [বর্তমান মৌলভীবাজারের অধিকাংশ চা বাগান] আদমপুরে এক সভা হয়। তখন পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক আট আনা ও মহিলা শ্রমিকের মজুরি ছয় আনার দাবী ওঠে। অর্থাৎ ভেতরে ভেতরে বাগানগুলো অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। কিন্তু বাগানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ছিল না। ২ মে চরগোলাভ্যালির শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। ৩ মার্চ এই অঞ্চলের আনিপুর চা-বাগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ‘গান্ধী কা জয়’ বলে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এই খবর ঘন বন-পাহাড় ভেদ করে আশপাশের বাগানে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা বাঁধা উপেক্ষা করে বাগান ছাড়তে শুরু করে। বাগান কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সহায়তায় পথে পথে সর্দার ও পুলিশ বসায়। কোথাও কাথাও ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বাগানের রাস্তায় শ্রমিক চলাচল বন্ধ করা হয়। এই পরিস্থিতিতে চা-বাগানের বাইরে কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মীরা শ্রমিকদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কার্যত বাগানগুলো অচল হয়ে পড়ে। শ্রমিকরা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়া বা ‘মুল্লুকে চল্’ অভিযানকে শৃঙ্খল মুক্তির শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেয়। চরগোলার এই খবর সুরমা-ধলাই ভ্যালিতে আছড়ে পড়ে। বাগান কর্তৃপক্ষ পুলিশ-দালাল দিয়ে শ্রমিকদের কৌশলে আটকানোর চেষ্টা করে। সরকারি হিসাব মতে ‘মুল্লুকে’র পথে লঙ্গাইভ্যালির ৮,৭৯৯ জন, চরগোলাভ্যালির ৮,১১২ জন চা-বাগান ত্যাগ করেছিল। তবে সুরমা ও ধলাইভ্যালির ইউরোপীয় বাগানগুলোর কিছু শ্রমিক মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রওয়ানা দেয়। সব মিলে তখন প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক রওয়ানা দিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এই প্রথম কিছু চা-বাগানে একসাথে আগুন জ্বলে ওঠে।

চা-বাগান ছেড়ে শ্রমিকরা অনিশ্চিত ও অচিনপথে বের হয়ে প্রথমে করিমগঞ্জ রেল স্টেশনে জড়ো হয়। তারা আসাম-বেঙ্গল রেল পথে চাঁদপুর-গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। শ্রমিকদের হাতে টাকাকাড়ি ছিল না। অভুক্ত শ্রমিকদের স্থানীয় কংগ্রেস-খেলাফত কর্মীরা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশনায় আসাম-বেঙ্গল রেল কর্তৃপক্ষ চা-শ্রমিকদের পরিবহনে রাজি হয়নি। অবশেষ শ্রমিকরা বিকল্প হিসেবে সিলেট-কুলাউড়া-কুমিল্লা-চাঁদপুর রেলপথ ধরে পায়ে হেঁটে যাত্রা করে। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মীরা দিকে দিকে চাঁদাতুলে সাহায্যের হাত বাড়ায়। শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে সিলেট রেল স্টেশনে চলে আসে। তাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা হয় নব গঠিত ‘জাতীয় বিদ্যালয়ে’। শ্রমিকদের উস্কানির অজুহাতে আসাম সরকার বহু শ্রমিক ও কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে ওঠে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রায় অনড় থাকে। তারা বাগানে ফিরে যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। রাজনৈতিক চাপে আসাম-বেঙ্গল রেল শুধু মহিলা ও শিশুদের চাঁদপুরে নিয়ে যেতে সম্মতি দেয়। অতপর দৃঢ় শ্রমিকরা সিলেট-চাঁদপুর রেল পথ ধরে পায়ে হাঁটতে থাকে। দিনান্তে কংগ্রেসীদের দেওয়া খাবারের ওপর তারা নির্ভরশীল ছিল। শ্রমিকদের পদযাত্রা সহায়তা করার জন্য রেল-লাইনভিত্তিক থানা ও মহকুমা কংগ্রেস সাহায্য কমিটি গঠিত হয়। করিমগঞ্জের কামিনীকুমার চন্দ, শ্রীশচন্দ্র দত্ত; সিলেটের যতীন্দ্রচন্দ্র দত্ত, যতীন্দ্রনাথ দে, নীরোদকুমার গুপ্ত, অবলাকান্ত গুপ্ত, সতীন্দ্রনাথ দেব, কুমিল্লার অখিল দত্ত, চট্টগ্রামের যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, চাঁদপুরের হরদয়াল নাগ প্রমুখ শ্রমিকদের পাশে থেকে সমন্বয় করেন।

রেল পথে অভুক্ত শ্রমিকদের হেঁটে সহজ ছিল না। একাধারে প্রায় সতের দিন চলার পর দুর্দশাগ্রস্থ শ্রমিকরা অবশেষে ১৯ মে চাঁদপুরে ঘাটে পৌঁছে। তার আগেই তৎকালীন চাঁদপুরের মহকুমা প্রশাসক সুনীল কুমার সিংহ, প্ল্যান্টার্স প্রতিনিধি ম্যাক্ফারসন পুলিশ নিয়ে মৃত্যু ফাঁদ পেতে বসে থাকে। তারা যেকোনো মূল্যে শ্রমিকদের আটকাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। সেদিন রাতের বেলা পুলিশের তাড়া খেয়ে শ্রমিকরা দিগি¦দিক ছুটে জাহাজে উঠার চেষ্টা কালে জাহাজের পাঠাতনে তুলে দেওয়া হয়। ফলে অসংখ্য শ্রমিক জলের টানে চিরতরে হারিয়ে যায়। চাঁদপুর রেল স্টেশন শ্রমিকদের কান্না ও আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এখানেই শেষ নয় কলকাতাগামী জাহাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০ মে ১৯২১ শ্রমিকদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ভয়ঙ্কর মৃত্যু দূত। সে দিন রাতে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার কিরণচন্দ্র দে ৫০ জন গোর্খা সৈন্য নিয়ে চাঁদপুর ঘাটে হাজির হয়। সঙ্গে ছিল ইউরোপীয় চা-কর ও চা-ব্যবসায়ীরা ছিল। সে রাত ছিল ঘোর বৃষ্টি। শ্রমিকদের ফিরিয়ে যাওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেক ক্ষতির পরও তারা মত পাল্টায়নি। অবশেষে মধ্যরাতে গুর্খা সৈন্যরা সাধারণ মানুষকে রেলস্টেশন থেকে সরিয়ে দেয়। গভীর রাতে গুর্খা সৈন্যদের অস্ত্র বেজে ওঠে। কংগ্রেসীরা মতে করতেন যে, তখন ‘চাঁদপুরে রক্ত গঙ্গা’ বয়ে যায়। অনেক শ্রমিক পদ্মার জলে পড়ে চিরতরে আত্মরক্ষা করে। অনেক নারী শিশু নিখোঁজ হয়ে যায়। অমৃতবাজার পত্রিকা বিষয়কে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগে’র মতো ঘটনা বলে প্রকাশ করে [অমৃতবাজার, ২৩ মে ১৯২১]। শেষ যজ্ঞের বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের পরের দিন জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।

এই বর্বরোচিত ঘটনার খবরে বঙ্গীয় কংগ্রেস ও খেলাফত নেতারা চাঁদপুর ছুটে আসেন। ৪ মে ২১ সালে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। চা-শ্রমিকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আইনজীবী সমাজ, আসাম-বেঙ্গল রেল, স্টিমার প্রভৃতি প্রায় তিনমাস ধর্মঘট করে। কয়েক মাস চা-বাগান কার্যত বন্ধ থাকে। চা-শ্রমিকদের যে রক্ত ধারা পদ্মায় পড়েছিল বা যাদের সলিল সমাধি হয়েছিল, তার সুদুরপ্রসারী প্রভাব শ্রমিকের ওপর পড়েছিল। চা-শ্রমিকদের এই ‘মুল্লুকে চল্’ অভিযান শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। চাঁদপুরে শ্রমিকদের প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে চা-বাগানের ‘নিষিদ্ধ জগত’-এ কিছুটা আলোর কিরণ পৌঁছার পরিবেশ পায়। শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতন কিছুটা লাঘব হয়েছিল মাত্র। শতবর্ষ পরে সেই চা-শ্রমিকদের উত্তরপুরুষ শ্রমঘাম দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে, তারা মুক্তিযুদ্ধে বড় অবদান রেখেছিল। আজকের শ্রমিকরা পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ও ঠিকানা ভুলেছে বহু আগেইশতবছর পরে তাদের জীবন-মানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে তা দেখার বিষয়।