ফাহমিদা ইয়াসমিন
০১ ফেব্রুয়ারী , ২০২১
প্রাবন্ধিক
প্রবাসী লেখক
নারী শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে সমাজ, সংসার ও আগামীর প্রজন্ম। যে শব্দটি বহন করে পৃথিবীর সবকিছুর মাতৃত্ব। সেটা ভালো ও খারাপ যাই বলা হউক না কেনো। এজন্য সমাজ ও সংসারে বুদ্ধিমতী, ধৈর্যশীল নারীর খুবই প্রয়োজন। তাইতো রুডইয়ার্ড কিপলিং (জঁফুধৎফ করঢ়ষরহম) বলেছেন, ‘সবচেয়ে নির্বোধ নারীও একজন বুদ্ধিমান পুরুষকে সামলাতে পারে কিন্তু নির্বোধকে সামলাতে প্রয়োজন বুদ্ধিমতী নারী। ‘বাক্যটির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও বলতে চাই নারী হলো-একজন দক্ষ ও কৌশলি শিক্ষক। কেননা নারীর হাতেই একটি সমাজের সংহতি ও সুন্দর নিহিত থাকে।
নারী চাইলেই পাল্টে দিতে পারে একজন মানুষকে, একটা জাতিকে, পরিচিত করতে পারে একটি মানচিত্রকে বিশ্বদরবারে। এজন্যই ও হেনরি বলেছেন, সব বড় মানুষেরাই তাঁদের সাফল্যের জন্য কোন অসাধারণ নারীর সহযোগিতা এবং উৎসাহের ঋণের কথা বলেছেন। একজন সুজ্ঞানী নারী সংসার, দেশ ও সমাজের মেরুদন্ড। সংসারে যদি ভালো একজন নারী থাকে সে হতে পারে ভালো মা, ভালো স্ত্রী, ভালো স্বজন। ভালো নারী হবার জন ভালো চিন্তা প্রয়োজন এবং পরিপাশ্বিক সহযোগীতাও দরকার। নারী কারো কন্যা রূপে বেড়ে উঠে তারপর কারো স্ত্রী। যখন কোনো কন্যা ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত হয় মনের দুয়ারে শিক্ষার আলো ফুটে উঠে তখনি সে ভালো চিন্তা করে। শিক্ষার আলো যদি না থাকে তবে অন্ধকারেই বলা যায়। আর অন্ধকারে থেকেও অনেকেই ভালো পরিবেশ ও জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা ভালো থাকে তবে খুব কষ্টকর। আমাদের সমাজে এখনো নারীরা অনেক অবহেলার শিকার। আর এই অবহেলাটুকু পুরুষ থেকেই পাওয়া। হাদীসে আছে পুরুষের যেমন নারীর উপর অধিকার আছে নারীর ও তেমন পুরুষের উপর অধিকার আছে। কিন্তু পুরুষ নিজের অধিকার শুধু খাটাতে চায় অনৈতিকভাবে যা অন্যায়। তাই নারীদের ভালো মন্দটুকু বুঝার জন্য পড়াশোনা করতে হবে চোখ কান খোলা রাখতে হবে তবেই সুশিক্ষার আলোর প্রয়োজন। নারীকে জ্ঞানের অধিকারী করার জন্য সরকারি বেসরকারি ভাবে যেগুলো প্রয়োজন তার মাঝে কঠোর হস্তে বাল্য বিবাহ দমন করতে হবে। পাঠ্য পুস্তকে নারীর এগিয়ে যাবার মতো নীতি শিক্ষা প্রণয়ন করতে হবে। যার যার পরিবারকে সচেতন হতে হবে। কবি কাজী নজরুল ইসরামের ভাষায়, ‘বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ সুতরাং পৃথিবী সমাজ সংসার তখনি সুন্দর ও সুখি হবে যখনই নারীর মুক্তির পথ পুরুষ ভালো চোখে দেখবে। একজন সুন্দর মনের নারীর প্রয়োজন সমাজ সবসময় অনুভব করে। তাই সুন্দর ও মহৎ মনের নারী আপনা আপনি আসে না। সেজন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। শিক্ষার গুরুত্ব যে কতোখানি তা ইসলামের আলোকেও বিবেচনা করলে জানা যাবে। স্রষ্টা নিজেও শিক্ষার প্রতি বিশেষ দরদ দেখিয়েছেন। ইলম বা জ্ঞান ব্যতীত কোন ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। এজন্য ইবাদত করার পূর্বে শিক্ষা অর্জন করা সকলের উপর ফরজ। শিক্ষা লাভ করা থেকে নর-নারী কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। কেউ বিরত থাকতে পারবে না। আল্লাহপাক পুরুষকে যেমন শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন তেমন নারীকেও শিক্ষা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর বিধানে শিক্ষা অর্জন করা নর-নারীর সমান অধিকার। শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র কোরআন নাজিল করে মহান আল্লাহপাক সর্ব প্রথম যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশটাই হচ্ছে নর-নারীর জন্য শিক্ষা বিষয়ক। ইরশাদ হচ্ছে-‘পড় তোমার প্রভুর নামে” (সূরা আলাক: আয়াত-১)। শিক্ষা ছাড়া আল্লাহকে জানা বুঝা যাবে না বিধায় শিক্ষা অর্জন করা প্রথম ও প্রধান ফরজ। এই ফরজ কাজ থেকে বিরত থাকা মানেই সকল ক্ষেত্রে ধ্বংস ডেকে আনা। মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন শান্তির একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা। আর এই শিক্ষা নর-নারী উভয় কেই অর্জন করতে হবে। ইলম অর্জন করা সকল নর-নারীর উপর ফরজ ঘোষণা করে হযরত আনাস রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- ‘ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ’ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নারীদের পক্ষে। নারীদের শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। বিনামূল্যে বইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নারীশিক্ষার যে বিকল্প নেই তার প্রচার ও প্রসার করা সমাজের তথা রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র সেই কাজটি আমার মতে, যথাযথভাবেই পালন করে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই। শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজানো হয়েছে নারীবান্ধব করে। এখন শুধু নারীদেরকেই নিজেদের প্রয়োজনে নিজেকে জানতে নিজেকে গড়তে ও ভাঙতে শিক্ষাকে গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি করার সময়।
পরিবার তথা সমাজকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার দিতে হবে। যা বাংলাদেশে বলবৎ আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনেক পরে নারী শিক্ষার প্রচার ও প্রসার শুরু হয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু আশার কথা হলো, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়েও খুবই অল্প সময়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির স্বর্গশিখরে উঠেছে বলে বিশ্ববাসী মত প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের নারী শিক্ষার প্রধান বাধা হচ্ছে অল্প বয়সে বিয়ের প্রবণতা। এক্ষেতে পরিবারের ভ‚মিকাই বেশি। পরিবারের অসচেতনতার কারণেই অনেক মেয়েরই শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। নিজের পায়েও দাঁড়াতে পারে না মনের ভেতরে জমাট রাখে উঁকি দেওয়া স্বাবলম্বি হওয়া কিবা আকাশ ছোয়ার সকল স্বপ্ন, আশা ও ভালোবাসা। সেজন্য অবশ্য এখন সরকারও বাল্যবিবাহ বন্ধের আইন করেছে। এই আইন যে অন্য আইনের মতো বস্তাবন্দী বা খাতা কলমে আটকে নেই তার প্রমাণও ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। এই যে বাল্য বিবাহ রোধে সরকারের বিশেষ কঠোরতা এটাই মেয়েদের সুশিক্ষিত করতে অনেক পথ এগিয়ে নেবে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র হবে সুন্দর ও সুন্দরের প্রতীক।
আমাদের দেশে যে সব নারী বিদ্যা শিক্ষা নিচ্ছে, তারা যদি পুরুষতান্ত্রিক রক্তচক্ষু ও হীন মানসিকতার কারণে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে না পারে তবে তা হবে দুঃখজনক। এ ব্যাপারে নারীকেই অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে অগ্রণী ভ‚মিকা নিতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য। কারণ শিক্ষার সকল পথকে সরকার সহজ করে দিয়েছে। সরকার বইয়ের পাশাপাশি আর্থিক সুবিধে দিয়ে নারীদের এগিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর। সমাজের শিক্ষার আলো জ্বালাতে জাগতে হবে নারীকেই। নারী শিক্ষিত না হলে জাতি শিক্ষিত হবে কীভাবে? তাই বলি-‘জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা, ঘরে ঘরে জ্বালাও শিক্ষার আলো। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।’