Cinque Terre

সিদ্দিকুর রহমান

১৪ জুন , ২০২০


অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা 


করোনাকালে বাজেট ভাবনা

কোভিড-১৯-এর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি গোটা বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব অর্থনীতিই মন্দায়। অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে, তা-ও বলা কঠিন। এ রকম এক কঠিন সময়ে সরকারকে এবারের বাজেট পেশ করতে হলো সংসদে।

তবে নতুন কোনো চমক করোনাকালে পরিবর্তন নিয়ে আসবে তেমন কিছু বাজেটে দিতে পারেননি  অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বলতে গেলে বাজেটের সেই গতানুগতিক পরিসংখ্যানেই আটকে থাকলেন তিনি। কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় সরকারের আয় ও বেসরকারি বিনিয়োগে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধন এনেছেন সামান্যই। তিনি সংসদে জানিয়েছেন, রাজস্ব আয় এবার কম হবে মাত্র ২৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এর ওপর ভিত্তি করে অর্থমন্ত্রী নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বড় আয়-বড় ব্যয়ের বিশাল এক বাজেটের প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য রেখেছেন ৮ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চবিলাসতো বটেই।

এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ হতে হবে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির বৃদ্ধি গত অর্থবছরে মোটেই সন্তোষজনক ছিল না। সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ের কারণে বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতি সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। 

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট উপস্থাপনে গতানুগতিকতা ছিল না। দীর্ঘ বক্তৃতাও ছিল না।

অর্থমন্ত্রী অর্থনীতির উত্তরণের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। নানা ধরনের পরিকল্পনার কথা বলেছেন। অবশ্য অর্থনীতি নিয়ে আশার কথাও শুনিয়েছেন। ছাড় দিয়েছেন স্থানীয় শিল্পকে, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ছাড় মিলেছে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করেও। উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে করপোরেট করের হারও কমিয়েছেন। আবার সিগারেট, গাড়ি ও মুঠোফোনে কথা বলার ওপর কর বাড়িয়েছেন। 

বড় বাজেট দেওয়া অর্থনীতির জন্য নতুন কিছু নয়। তবে এর ভিত্তি হচ্ছে রাজস্ব আয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে আয়ে বড় ধরনের ধাক্কাতো আছেই। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) মনে করে, এবার রাজস্ব আয়ে ঘাটতি কম করে হলেও ৮০ হাজার কোটি টাকা হবে। কারও কারও মতে, ঘাটতি আরও বেশি হবে। আর নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে গতানুগতিক বলে অভিহিত করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করে, করোনাভাইরাসের শিক্ষা থেকে বাজেটে যে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী পদক্ষেপ দরকার ছিল, তা নেই। বরং বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায় ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যগুলো বাস্তবতা থেকে দূরে।

সিপিডি বাজেটে ধনীদের কেন কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, কেন কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটি হিসাব করে দেখিয়েছে, ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের ক্ষেত্রে সরকার যে ছাড় দিয়েছে, তাতে একজন নিম্নবিত্তের কর কমবে ৫ হাজার টাকা। আর অতিধনীর কমবে ২  কোটি ৩৮ লাখ টাকা পর্যন্ত।

সম্প্রতি আইএমএফ বলেছিল, নতুন অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৯ শতাংশ। বাজেট পেশ করার আগে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, নতুন অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আইএমএফের ওপরই ভরসা রেখেছেন। আর এ কারণেই হয়তো বড় বাজেট, বড় জিডিপির সেই পুরোনো ধারার মধ্যেই নিজেকে রেখে দিলেন। অথচ সারা বিশ্বই আবার জিডিপির পেছনে না দৌড়ে জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর দিকেই ছুটছে।

আবার এ সময় দেশের মানুষের উদ্বেগ মূলত দুটি বিষয় নিয়ে। যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি। করোনাভাইরাস দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো ও অব্যবস্থাপনার চিত্রটাই সবাইকে দেখিয়ে দিচ্ছে। সারা বিশ্বই নতুন করে ভাবছে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে। অথচ নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাত অগ্রাধিকার পাবে এ  ঘোষণার বাইরে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা রয়েছে। থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি টাকা রাখার কথাও বলেছেন। তবে এই অর্থ দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ তৈরি, ভেন্টিলেটর কেনা, দেশের সব মানুষের দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আসলে এই মুহূর্তে মানুষকে এই ভরসা কতটা দিতে পারবে,  সেটাই বড় প্রশ্ন। কেননা, বরাদ্দের বাইরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে নতুন চিন্তা ও সংস্কারের কোনো পদক্ষেপের ঘোষণা নেই নতুন বাজেট প্রস্তাবে। 

নতুন অর্থবছরের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকার। আর ঘাটতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই রাখা হয়। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ফলে বাজেট ঘাটতি এবার বেশি হলেও আইএমএফ কিছু বলবে না। তবে প্রতিবারই বড় বাজেট করা হয়, ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হয়। ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি কমিয়ে বাজেট ঘাটতি সীমার মধ্যে রাখা হয়।

সবার চাওয়া জীবন বাঁচানো, জীবিকা বাঁচানো। নতুন বাজেট এ দুটি কাজ কতটুকু করতে পারবে, তার ওপরই নির্ভর করবে বাজেটের ভালো ও মন্দ। অর্থ ব্যয় নয়, ব্যয় করা অর্থ কতটা কাজে লাগল, সেটাই হবে এবার বাজেট বাস্তবায়নের সাফল্যের মূল জায়গা।

বাজেট বরাবরই সরকারের কাছে অনন্য আর বিরোধীদলের কাছে নগন্য। কিন্তু জনগণের আশা আকাক্সক্ষা আর জীবন-জীবিকার বাস্তব প্রতিফলনই সরকারের বাজেট প্রণয়নের সার্থকতা। নয়তো বিশাল ঘাটতি বাজেট অর্থনীতির চাকাকে কোনোদিনই টেনে তুলতে পারবে না।