Cinque Terre

প্রণতি চক্রবর্তী

০৩ ফেব্রুয়ারী , ২০২৪


গদ্যলেখক ও প্রাবন্ধিক
ব্রতী, ‘আমার সোনার ময়না পাখি’


আমি লেখিকা নই, আমি একজন মা। দেবাশীষ দে বাসু ও বহ্নি দে’র সর্বকনিষ্ঠা কন্যা ব্রতীকে নিয়ে আমার মনের কষ্ট সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্যই আমি কলম হাতে নিয়েছি।

একটা বিখ্যাত গান কাল থেকেই বার বার মনে পড়ছে ও গুন গুন করে আপনমনে গাইতে গেলেই চোখে জল আসে। গানটি, 

‘আমার সোনার ময়না পাখি, 

কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে

দিয়া মোরে ফাঁকি রে, আমার সোনার ময়না পাখি’

আমি ব্রতীর জেঠিমনি, সে আমাকে জেঠিমনি ডাকত। কারণ বাসুদা, অ্যাডভোকেট বেদানন্দ’র ছোট ভাই বলে। ওদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে একটা সুসম্পর্ক আছে, তাই বাচ্চারা আমার খুব আপন ছিল। আমার মনে হয়, বাচ্চাদেরকে খুব ভালো বুঝেন তার বাবা-মা, পরিবারের লোকজন, স্কুলের শিক্ষক, গানের শিক্ষক, আরোও ঘনিষ্ট অন্যরা।

আমি গান করি, এই কারণে আমার সৌভাগ্য হয় প্রতিবছর রামকৃষ্ণ মিশনে (আশ্রমে) ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে চারদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের যেকোনো একটি বাচ্চাদের নিয়ে আলেখ্যানুষ্ঠান করার। যে কারণে, প্রায় এক থেকে দেড় মাস সপ্তাহে দু-তিন দিন ওদের নিয়ে আমার বাসায় গানের রিহার্সেল করতাম। প্রতিবছরই কিছু নতুন বাচ্চা আসত আবার কিছু পুরাতন বাচ্চা আসত না। এভাবেই সৌভাগ্যবশত এ ময়না পাখি ব্রতীকে আমি পাই। বয়স ৬/৭ বছর। তাঁর মা তখন অসুস্থ। আমাদের সবার মামা সেন্ট্রাল ফার্মেসীর সজল মামাই প্রায় সময় রিহার্সেলের জন্য তাকে বাসায় আগে দিয়ে যেতেন আর পরে এসে নিয়ে যেতেন। যেহেতু আমি একজন ব্যাংকার ছিলাম তাই মাঝে মধ্যে অফিস থেকে বের হতে দেরি হতো। আবার রিহার্সেলের দিন সঠিক সময়েও আসার চেষ্টা করতাম। 

কি করে জানি দু-একদিনের ভিতরেই অন্য বাচ্চার মতো ব্রতীও আমার সন্তান হয়ে উঠল। সে ছোট ছোট পায়ে আমার সকল ঘর হেঁটে বেড়াত, বিছানায় আমার মেয়ের সঙ্গে শুয়ে পড়ত। পেটে ক্ষুধা লাগলে খেতেও চাইত। 

রিহার্সেল করাচ্ছি, হঠাৎ দেখি একদিন ব্রতী সামনেই। তো আমি আস্তে করে উঠে রান্নাঘরের দরজায় যেতেই দেখি আমার ঘরে একটি মেয়ে ছিল। ব্রতী তাকে অর্ডার করছে ঘি নামাও, চিনি নামাও, পাউরুটি নাও। এখন তাওয়া বসিয়ে ঘি-চিনি দিয়ে এরমধ্যে পাউরুটি সেঁকে দাও। সে দিল, তারপর ব্রতী প্লেটটি নিয়ে ভিতরে আমার মেয়ের বিছানায় গিয়ে বসে মজা করে খাচ্ছে। এভাবেই প্রতিদিন সে নিজের মতো করেই মজা করে খেত। আমার খুব ভালো লাগত। যে গানগুলি শিখাতাম সেগুলি মুখস্ত করতে হতো সবাইকে, সেও করত। একদিন বহ্নি বৌদি মানে ব্রতীর মা আমাকে বলছেন, বৌদি ব্রতী তো বাথরুমে স্নানে ঢুকে এই গানগুলি করে। আর আমাকে বলে, “জানো মা, জেঠিমনি যে কি করে, এতো কঠিন কঠিন গান শিখায়”। তার এত প্রতিভা ছিল, সে বড়দের গানগুলি মুখস্ত করে নিয়েছিল এবং অনুষ্ঠানে করেছিল।

অনুষ্ঠানের দিন সজল মামা দুপুর বেলা এনে দিয়ে যান আর বহ্নি বৌদি কাপড়-চোপড় সঙ্গে করে দিয়ে দেন। হঠাৎ দেখি, ও মাথায় শ্যাম্পু করেনি। আমি করিয়ে দিলাম, খুব খুশী হয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কারণ, তখন তার মা অসুস্থ ছিলেন।

আজ যখন লিখছি জানুয়ারির ৩০ তারিখ, সকালে মিশনের অধ্যক্ষ মহারাজের সঙ্গে আলাপ করছি তখন মহারাজ বললেন, তিনিও নাকি একবার শ্রী শ্রী সারদা মায়ের অনুষ্ঠানে লালপাড় শাড়ি পড়িয়ে মন্দিরের সামনে ব্রতীকে ঘন্টা দেড় ঘন্টা বসিয়ে রেখেছিলেন। সেও বসে ছিল। পরে নাকি মহারাজ ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কেমন লেগেছে তোমার’।  

ও ছিল শান্ত, মেধাবী, স্থিতধী। আমি কি লিখেছি জানি না, আমার ভালো লাগছিল না একেবারেই। তাই এ লিখা। 

যে জন্মেছে সবার পরে, সে চলে গেল সবার আগে। আমি তাঁর আত্মার শান্তি ও পারিবারের শান্তি কামনা করছি।

ভালো থাকিস মা, যেখানেই থাকিস। -তোর জেঠিমনি।