Cinque Terre

দীপংকর মোহান্ত

২২ ডিসেম্বর , ২০২২


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


মৌলভীবাজার পিটিআইয়ে দেশ নির্মাণের করুণ-গাথা (শেষপর্ব)

পিটিআই ও ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউস বা পর্যটন কেন্দ্রের বধ্যভূমি ও গণকরব 

পিটিআই বধ্যভূমিতে কয়েকশত লোককে ধরে এনে হত্যা করেছিল বলে ধারণা করা হয়। পাশের নির্জন বনভূমিতে লাশগুলো শেয়ালের আহারে পরিণত হয়েছিল। এই বধ্যভূমি নিয়ে কোনো ক্ষেত্র সমীক্ষা হয়নি বলে শহীদের নাম পাওয়া যায় না। ২০১৯ ফলে প্রবাসী লিয়াকত হোসেন একদিন পিটিআই এসে হাজির হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এসেছিলেন তাঁর শহীদ ভাই নজাবত আলীর কবর চিহ্নিত করতে। তাঁর কান্না দেখে সেদিন অনেকে কেঁদেছিলেন। কিন্তু ঘনজঙ্গলের মধ্যে ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের কোথাও গণকবরের চিহ্ন পাওয়া গেল না। স্বাধীনতার পর পিটিআই ও ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের কোনো গণকবর সংগৃহীত হয়নি। সেই গর্তগুলো অনেক আগেই ভরে গেছে (এই লেখকও অনেক গর্ত দেখেছিলেন)। অবশেষে লিয়াকত আলীর কয়েকটি শহীদ পরিবাররের কথা জানালেন যাদেরকে পিটিআই বধ্যভূমিতে নিয়ে পাকসেনারা হত্যা করেছিল। অবশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা সজল চক্রবর্তীর (রাজনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধ কমান্ডার) সহায়তার পিটিআই বধ্যভ‚মিতে শহীদ হওয়া পরিবারগুলোর একটি মিলনমেলার মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সে অনুষ্ঠানে অশতিপর তাছির আলী (মূলবাড়ি: ফতেপুর, রাজনগর। বর্তমানে কানাইঘাটের দরবস্ত বাজারে থাকেন) অনেক কষ্ট করে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁকে শহীদ নজাবত আলীর সঙ্গে একই ঝুটনিতে পর্যটন কেন্দ্রের বধ্যভূমির গর্তের পাশে গুলি করেছিল। তিনি  দ্বৈবক্রমে বেঁচে যান। শহীদ নজাবত আলী তাঁর আপন শ্যালক। নজাবত আলী তখন ঢাকায় পড়াশুনা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাবার পাঠাতেন। এই খবর রাজাকারের মাধ্যমে সেনাদের কাছে যায়। তাছির আলী ছিলেন সেদিন গোপনে শ্বশুড় বাড়িতে ছিলেন। তিনিও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য আদান-প্রদান করতেন। পাকসেনারা ভোরবেলা ১০-১২ টি জীপ নিয়ে এই বাড়ি আক্রমণ করে। তাঁরা লুকিয়ে খড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। রাজাকাররা ওখান থেকে ধরে নির্যাতন করে পিটিআই ক্যাম্পে কয়েকদিন আটকে রাখে। তথ্য পাওয়ার জন্য তাদের ওপর অত্যাচার করে। না খেয়ে নির্যাতনের মুখে তারা এমনিতেই মরার মতো হয়েছিলেনশরীরের কোনো চামড়া ছিল না। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সেনারা পূর্ব দিক আটকানোর জন্য ডিফেন্স দেয়। তখন অনেক বন্দিকে হত্যা করে। তাছির আলী বলেন, নজাবতসহ প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করে একই সময়। তাছিল আলীর মনে আছে যে, তাদের পরনে তেমন কাপড় নেই, হাঁটার শক্তিও নেই, সবাইকে ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের পূর্ব দিকের ঢালুকে একটা গর্তের পাশে নিয়ে যায়, সবাই ক্ষীণ কণ্ঠে ‘কলমা’ পড়ছে। হঠাৎ বৃষ্টির মতো গুলির ঝাঁক এসে তাঁদের ওপর পড়েÑতাছির আলী ছিলেন কয়েকজনের ঝুটনির মধ্যে। ঝুটনির সবাই গর্তে পড়ে গিয়ে ছটপট করে নিথর হলে রক্তের জোয়ার ছুটেছে চারদিকেতিনি সেই রক্তের মধ্যে পড়ে তিনি লাল হয়ে গেছেন। পাঞ্জাবীরা ভেবেছে তিনি মারা গেছেন। একটু পড়ে জল্লালদের ডাক আসে অন্যত্র যুদ্ধে যাবার। তাছির আালী সারা দিন লাশের মধ্যে পড়ে থাকেন। সন্ধ্যের পর অন্ধাকারে হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসেনআর পিছনে তাকাননি। তার কয়েক দিন পরেই মৌলভীবাজার স্বাধীন হয়। পিটিআই বধ্যভূমিতে শহীদ হওয়া কয়েকজনের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।

১. শহীদ শ্রীনিবাস ভট্টাচার্য ওরফে বলাই, পিতা: দক্ষিণারঞ্জণ ভট্টাচার্য। নিজস্ব বাসা: কাশীনাথ রোড, দীঘির পূর্বপার (তিনি মৌলভীবাজার কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। অবিবাহিত। তাদের কেউ আর সে জায়গায় থাকেন না)। তাঁকে ২৮ মার্চ পিটিআই নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরে তাঁর শরীর পেট্রল দিয়ে জ্বালায়।

২. শহীদ গৌরাপদ দেব ওরফে কানু, পিতা: গোপেন্দ্রচন্দ্র দেব; গ্রাম: আটগাঁও, সদর, মৌলভীবাজার [তখন কাশীনাথ রোডে ভাড়া বাসায় থাকতেন। প্রথম প্রহরে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ তাঁকে ধরে এবং পিটিআই-এ নির্যাতনের পর ২৯ মার্চ গুলি করে। পরে মারা যান।

৩. বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মনির মিয়া, পিতা: জমিল মিয়া, বাড়ি: তাহর লামু, রাজনগর (যুদ্ধ প্রশিক্ষণের পর যুদ্ধ করতে এলাকায় এসেছিলেন। কিন্তুপরিজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নভেম্বরে তিনি পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে পিটিআই বধ্যভ‚মিতে নিয়ে হত্যা করে)

৪. শহীদ দানু মিয়া, পিতা: জমিল মিয়া, বালিগাঁও, রাজনগর, মৌলভীবাজার

৫. শহীদ ডা. যামিনী দেব, পিতা: শরৎচন্দ্র দে (মূলবাড়ি: আটগাঁও, মৌলভীবাজার সদর। তিনি ইন্দেশ্বর চা বাগানের ডাক্তার ছিলেন)

৬. শহীদ তারা মিয়া, পিতা: ধনাই মিয়া, গ্রাম: চানভাগবস্তি, রাজনগর, মৌলভীবাজার

৭. শহীদ বাদশা মিয়া, পিতা: ওয়াব/ওহাব উল্লাহ, নোয়াটিলা, রাজনগর, মৌলভীবাজার

৮. শহীদ নজাবত আলী, পিতা: সিকন্দর আলী, নোয়াটিলা, দক্ষিণ খলাগাঁও, রাজনগর

৯. শহীদ সৈয়ম রফিকুল ইসলাম, পিতা: সুরুজ মিয়া, গ্রাম: ব্রাহ্মণগ্রাম, রাজনগর, মৌলভীবাজার

১০. শহীদ বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, পশ্চিমভাগ রাজনগর, মৌলভীবাজার

১১. শহীদ নিখিল চক্রবর্তী, পশ্চিমভাগ, রাজনগর, মৌলভীবাজার

১২. শহীদ মছদ্দর আলী, পিতা: মনসুর আলী, বাড়ি: সুলতানপুর (বর্তমানে পৌরসভা), (তিনি কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন। একদিন ‘কুচা’ দিয়ে বেড়ীরপার লেকে মাছ ধরতে ছিলেন। পরণের লুঙ্গিকে প্যাচ ছিল উপরের দিকেপাকসেনারা ভেবেছে তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে  সেনারা ধরার পর তিনি হাসতে থাকেনপরে ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসের বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে)।

১৩. শহীদ বাদল মিয়া, (তাঁর আসল বাড়ি আসামের দিকে ছিল। তিনি সম্ভবত আসামের লাইন প্রথা আন্দোলনের সময় আসামের মুসলমানের সঙ্গে মৌলভীবাজারের সুলতানপুর গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আবার কারো মতো ছেচল্লিশ সালে তিনি সে অঞ্চল থেকে এসেছিলেন)।


চূড়ান্ত যুদ্ধ ও মৌলভীবাজার ব্রিগেডিয়ার হেড কোয়াটারের পতন :

কমলগঞ্জের ধলই চা বাগানের বিওপি ভারতের কমলপুর সীমান্তের খুব কাছাকাছি। বাংলাদেশের দিকে টিলা ওদিকে কিছু সমতলভূমি। পাকসেনারা ধলই সীমান্ত ফাঁড়ি খুবই সুরক্ষিত রাখে। এই ব্যূহ ভাঙতে মুক্তি ও মিত্র বাহিনী কয়েকবার যুদ্ধ করেও পাকদের হঠাতে পারেনি। এই যুদ্ধে ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি ৬১ মাউন্ট ব্রিগেডকে ধলই আক্রমণের নির্দেশ দেন। ব্রিগেডিয়ার ইয়াদভ ২ জ্যাট ব্যাটলিয়ানকে ২৮ অক্টোবর দুপুরের মধ্যে আক্রমণের সময় বেঁধে দেন। বিওপির অনতি দূরে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়। পরে বেঙ্গল রেজিমেন্ট মরণঘাতি যুদ্ধে নামে। পাক সৈন্যদের ৩১৩ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট যুদ্ধ করে। তারা টিলার ওপরে থাকায় অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। অতঃপর ২৮ অক্টোবর মরণঘাতি যুদ্ধে বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জীবনের বিনিময়ে পাকসেনাদের হঠানো সম্ভব হয়। উভয়পক্ষে অনেক রক্ত ঝরে। যুদ্ধের ইতিহাসে ধলই যুদ্ধ অন্যতম। এই বিজয় ধরে রাখতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী অনেক কাঠ-খড় পোড়ালে পাক সেনারা পিছু হটে। এটি ছিল এতদাঞ্চলে প্রথম বিজয়। কারণ ওখানে পাকরা আর ফিরে যেতে পারেনি। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের মাথা ভাঙে। অতঃপর শমসেরনগর বিমান বন্দর, লাঠিটিলা ও দিলকুশা চাবাগানের ব্যূহে বারবার আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং সিলেট রক্ষা তাদের জন্য মাথা ব্যথা হয়ে ওঠে। 

নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে পাক সেনা এবং মিত্র বাহিনী যার যার পরিকল্পনা গোপনে করতে থাকে। নভেম্বরে মিত্র বাহিনীর ৫৯ ব্রিগেড দক্ষিণ-পূর্ব দিকের বিওপিতে প্রচণ্ড হামলা করে বাংলাদেশের অনেক ভিতরে প্রবেশ করে চলে যায়। অর্থাৎ শ্রীমঙ্গল শুরু করে বড়লেখা পর্যন্ত পাকসেনাদের সেই সীমান্তবর্তী ইপিআর ক্যাম্পযা পাক সেনারা দখল করে থাকে, সেগুলো ধ্বংসের চেষ্টা চালায়। সে সময়ের বিভিন্ন সমরবিদদের লেখা ও কাগজপত্রে প্রতীয়মান হয় যে তখন রণ-কৌশল কয়েকবার পাল্টানো হয়েছে। পাকসেনারা ভারত থেকে আসার সম্ভাব্য সকল পথে ডিফেন্স রাখে। মিত্র বাহিনী সীমান্ত ফাঁড়িগুলো গুটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায় তার পাশপাশি বিভিন্ন ফাঁড়ি পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মিত্রবাহিনী ৮১ মাউন্টেনইন ব্রিগেড (সঙ্গে আরো সহায়ক দল ছিল) মৌলভীবাজরের দিকে রাখে। তারা পাক সেনাদের শক্তি ক্ষয় করা এবং সেনারা যাতে পুনরায় একত্রিত না সে জন্য ১. ধর্মনগর থেকে কুলাউড়া- ব্রাহ্মণবাজার-ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে তাড়া দেওয়া এবং ২. কৌলাশ্বর/ কৈলাশ্বর/ কৈলাশহর থেকে কমলগঞ্জ-শমসেরনগর-মৌলভীবাজার দিয়ে অগ্রাভিযান চালাতে প্রস্তুত হয়। এই দলের কাজ ও লক্ষ্য নির্ধারিত হয় মৌলভীবাজার-শেরপুর-সাদিপুর ফেরিঘাট দখল করা। মুক্তিবাহিনী ও গুর্খা সৈন্য মিলে কুলাউড়ার লাঠিটিলা মুক্ত করতে গিয়ে কিছু গুর্খা শহীদ হয়। ২ ডিসেম্বর দিলখুশা চা বাগানে স্বাধীনতার পতাকা ওঠে (২৫ নভেম্বরের পর থেকে পাক সেনারা পালাতে থাকে)। ৫ ডিসেম্বর ৪-৫ গুর্খা রাইফেলস হাতাহাতি যুদ্ধ করে কুলাউড়ার গাজীপুর চাবাগানের ব্যূহ ধ্বংস করে। অনেক গুর্খা সৈন্য শহীদ হয়। একই সময়ে ৯ গার্ড ব্যাটালিয়ান কাপনা পাহাড়ের পাকদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পাকদের গাজীপুর দূর্গ ও কাপনা পাহাড়ের বাঙ্কারগুলো ভাঙ্গার ফলে মৌলভীবাজারে তাদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। কুলাউড়া অঞ্চলের পাক সেনারা সহজে রেল পথ ধরে ফেঞ্চুগঞ্জ গিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালায়। ৬ ডিসেম্বর ৬ রাজপুত কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার দখল করে। অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর সকল গ্রুপ কুলাউড়ায় এক হয়ে যায়এবং বিশাল অংশ মুক্ত হয়।

মৌলভীবাজারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পাকসেনাদের ৩১৩ পদাতিক ব্রিগেডের ছোট ছোট কোম্পানি পাস্পরিক যোগাযোগ দ্রুত হারাতে থাকে। তারা পুনরায় মৌলভীবাজারের ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা চালায়। এদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে মিত্র বাহিনীর নানা ইউনিট কাজ করে। পাকদের ২০২ অ্যাডহক ব্রিগেড আলাদা ভাবে সিলেটে ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার রানার নক্সায় সীমান্তবর্তী অবস্থানের প্রতিটি রাস্তায় থাকে। সিলেটের পূর্বদিক রক্ষার জন্য অর্থাৎ সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট কোম্পানীগঞ্জ (বর্তমান), কানাইঘাট-চারখাই, জৈন্তা-হেমু রক্ষার জন্য ‘৩১ পাঞ্জাব, ৯১ মুজাহিদ ব্যাটালিয়ান, ইপিসিএ এফ ২ কোম্পানি,  উইং ফ্রন্টিয়ার কোর , ৫০০ রাজাকার,২/৩ ব্যাটরি (৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট) নিয়ে’ ২০২ পুনর্গঠিত ও মোতায়েন করে।

অন্যদিকে কৈলাশর থেকে ক্রমাগত আক্রমণে  ১ ডিসেম্বর শমসেরনগর বিমান ঘাঁটি প্রায় পাকসেনা মুক্ত হয়। ২ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী চাতলাপুর দিয়ে প্রবেশ করে শমসেরনগর বাজার এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তখন ভারতীয় মেজর গুরম শহীদ হন। পাক সেনারা শমসেরনগর ডাকবাংলা ছেড়ে মুন্সিবাজারের দিকে পলায়ন করে। ওখানে পাক সেনারা কোনো ক্রমেই মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারেনি। তখন কৌশল ছিল মুক্তিযোদ্ধারা যার যার এলাকা দিয়ে প্রবেশ করবেসংশ্লিষ্ট এলাকা তাদের জানাশোনা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে। মুক্তিযোদ্ধারাও অনেক পটুত্ব অর্জন করে নিয়েছিলেন। পাক সৈন্যরা পিটিআইয়ের দিকে পশ্চাৎপদ অনুসরণ করতে থাকে। তখন তাদের কমান্ড প্রায় পুরোটা ভেঙ্গে পড়েচারদিকে থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের পালাবার জন্য কেবল সেই শেরপুর-সাদিপুর-সিলেট রাস্তাটি খোলা থাকে। মিত্র বাহিনীর বিশাল দল আর্টিলারী সার্পে নিয়ে কুলাউড়া-ফেঞ্চুগঞ্জ-হয়ে সিলেট অভিমুখে অভিযান চালায়।

শমসেরনগর ২ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। শমসেরনগর থেকে একটি দল রাজনগর হয়ে মৌলভীবাজারের পথ ধরে। আরেকটি দল ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল হয়ে মৌলভীবাজার যাওয়ার পথে মার্চ করে। তৃতীয় বৃহৎ দলটি মুন্সিবাজার আক্রমণ করে ৩ ডিসেম্বর। মুন্সিবাজারে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুন্সিবাজার থেকে বড় দলটি নির্জন পাহাড়ি পথে মুন্সিবাজার-বাবুরবাজার-বড়টিলা-কালেঙ্গা হয়ে পিটিআই হেড কোয়ার্টার দখলের জন্য রওয়ানা দেয়। দলের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লক্ষণ সিং এবং রেজিমেন্টের গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন সমন সিংহ। তিনি মানচিত্রের সঙ্গে মিল রেখে মার্চ করাতেন। ৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী বর্ষিজোড়া পাহাড়ের ভিতরে ক্যাম্প করে। পাক গোয়েন্দাদের কাছে বার্তা ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী বড়টিলা-কালেঙ্গার রাস্তা দিয়ে আসছে। ফলে হেডকোয়ার্টার রক্ষার জন্য পাক সেনারা বড়টিলার নীচে গোপন বাঙ্কারে প্রচুর অস্ত্র ও সৈন্য রাখে। যা অগ্রবর্তী মিত্র বাহিনী বুঝতে পারেনি। এবং পিটিআই হেড কোয়ার্টারে তাদের কী পরিমান শক্তি ছিল তারও সঠিক তথ্য ছিল না। অথচ মিত্র বাহিনী নিশ্চিত ছিল যে, পিটিআই-এর ব্রিগেড নিশ্চিহ্ন করে দিলে পাকসেনাদের সিলেট গিয়ে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না। এমতাবস্থায় পাকসৈন্যরা মূলত আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা এতই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল যে, পরবর্তী কাজের কোনো নির্দেশনা বা বার্তা তেমন সংগ্রহ করতে পারেনি। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পরপর বড়টিলার কাছে পাক সেনা ও মিত্র বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের সৈন্যরা এই যুদ্ধে থাকে। প্রধান গাইড হিসেবে ছিলেন মির্জা আজিজ আহমদ বেগ (তিনি ছিলেন এই এলাকার সন্তান। প্রথম দিকের আওয়ামীলীগার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা)। এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা বীরের মতো জীবনাহুতি দিয়ে পাক সেনাদের নির্মূল করেছিল। লোকশ্রুতি আছে যে নির্ভীক গুর্খা সৈন্যরা দা হাতে নিয়ে পাক বাঙ্কারে গিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধ করে ওদের মারে ও নিজেরাও মরে। এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারি সাপের্ট থাকায় পাকরা তখন দ্রুত পিছু হটে পিটিআই না গিয়েই প্রাণ নিয়ে শেরপুরের দিকে পালায়। মর্টার সেলের আঘাতে তখন পিটিআই-এর পুরাতন হোস্টেলের ভবন অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়।


৭ ডিসেম্বর সারারাত উভয় পক্ষের গুলি মর্টার হামলা চলতে থাকেএই ফাঁকে পাক সেনারা পিছন হটতে থাকে। বড়টিলা থেকে লক্ষণ সিং কিছু যোদ্ধা নিয়ে সরাসরি পিটিআই হেড কোয়ার্টারে না এসে পেছনের দিকে থেকে এ্যাটাকের পরিকল্পনা করেন। তিনি মির্জা আজিজ আহমদ বেগসহ স্থানীয় গাইড নিয়ে আড়াল পথে গোয়ালবাড়ির জঙ্গল দিয়ে বিদ্যুৎ অফিসেঅর্থাৎ পাহাড়ি পথে বেজবাড়ী অভিমুখে যাত্রা করেন। ৮ ডিসেম্বর ভোর রাতে তারা গোয়েন্দার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, পাক সেনারা কাভারিং ফায়ার করে শেরপুরের দিকে দ্রুত পালাচ্ছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল লক্ষণ সিংয়ের নির্দেশে মেজর দায়ান দুই প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শহরের ভিতরে গিয়ে পিটিআই ভবন (বিগ্রেড হেড কোয়াটার), ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউস, মহকুমা অফিস, মৌলভীবাজার কলেজ, সরকারি গেস্ট হাউস, থানা, হাসপাতাল প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান নেন। সঙ্গে সম্মুখ ফ্রন্টের বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ গাইড মির্জা আজিজ আহমদ বেগ ছিলেন। আজিজ আহমদ বেগ সকালে পশ্চিমবাজার থানার দিকে খেয়াঘাটের কাছে স্বাধীন বাংলার গর্বিত পতাকা ওড়ান। মিত্র-বাহিনীর যে সীমানা ছিল শেরপুর পর্যন্ত তারা সে দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ততক্ষণে পাকসেনারা সাদিপুর অতিক্রম করে ফেলে। ইতোমধ্যে বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল আজিজ (এমপিএ) রাজনগর ‘শত্রুমুক্ত’ ঘোষণা করে দ্রুত মৌলভীবাজার শহরে পৌঁছেন। তিনি মহকুমা অফিসের নিকটে (আনসার ফিল্ড) ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও স্থানে স্থানে পতাকা উত্তোল করেন। এই আনন্দের মধ্যে শহরে মাইন বিষ্ফোরণের ভয় ছিল বেশি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের নারীমুক্তিযোদ্ধাদের (ক্যাম্পে বন্দি বীরাঙ্গণা) অবস্থা ছিল বড়ই করুণ। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী দ্রুত বাঙ্কার থেকে তাদের সরিয়ে নেয়। কাপড়ের অভাবে কয়েকজন শিখ সৈন্য তাদের পাগড়ি খোলে পরনের কাপড় দিয়েছিল বলে প্রত্যক্ষকদর্শীরা বলেছেন। তখন এই মায়েদের পরিচয় গোপন রাখার নিয়ম ছিল। বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গণা) পাওয়া যায় পিটিআই ব্যাঙ্কারে ও কক্ষগুলোতে বন্দি অবস্থায়। পাকসেনারা পালানোর সময় কয়েকজন নারীকে সার্কিট হাউসে হত্যা করে যায়। তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি। মির্জা আজিজ আহমদ বেগ পাঁচ-ছয়জন নিরাবরণ নারীর লাশ দেখে সৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। অসংখ্য মানুষ পিটিআই বধ্যভ‚মিতে ছুটে আসে নিখোঁজ নিকটাত্মীয়ের সন্ধানে। সেই সময়ের উৎসুক তরুণ মখলিছ মিয়া সৈয়াপুর থেকে পিটিআই বধ্যভ‚মি এলাকা দেখতে ছুটে চলে আসেন। কেন তিনি এসেছিলেনএমন প্রশ্ন করলে মখলিছ মিয়া জানান যে, তখন লোকমুখে পাকসেনাদের পিটিআই হেড কোয়ার্টারের নাম ছড়িয়ে পড়ে। লাশের সন্ধানে মানুষ সে দিকে কেবল ছুটে যায়। তিনি পিটিআই ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে গিয়ে দেখেন, কুয়োর মধ্যে অনেক লাশ। তাছাড়া নতুন বহুগর্ত থেকে দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়েছিল। পিটিআইয়ের পুকুরে ছিল লাশ, ট্যুরিস্ট রেস্ট ইউসের ঢালুগুলোতে কেবল গর্ত আর গর্তকোনো কোনো গর্ত থেকে শেয়ালে টানা লাশের হাত-পা দেখা যায়। কোথাও রক্তের তামাটে দাগ, কোথাও হাড়গুড় কঙ্কাল পড়েছিল। কোথাও নারী-পুরুষের পরনের কাপড়। দুঃখের বিষয় যে এই পর্যটন কেন্দ্রের দানবীয় বধ্যভ‚মির যেমন কোনো স্মৃতি চিহ্ন রাখার প্রয়োজনীয়তা কেউ মনে করেনি; তেমনি পিটিআইয়েও গড়ে ওঠেনি শহীদ স্মরণে কোনো সৌধ। পঞ্চাশ বছরে বীর মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং জনতা সবাই যেন ভুলে গেছেন পাক-ব্রিগেডের অত্যাচারের করুণ গাথা। একদিন মনে হয়েছিল ভাই হারানো প্রবাসী লিয়াকত হোসেন যেন ভুলে যাননি এই বধ্যভূমিকেযিনি স্বাধীনতার পরও তাঁর শহীদ ভাইয়ের লাশ খুঁজতে এসেছিলেন, কিন্তু পাননি। ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে এসে সেই গর্তও খোঁজে পাননি। এই লজ্জা কার! লিয়াকতক হোসেন আজ পরপারে। তাঁর সে দিনের চোখের জল যেন ধুয়ে দেয় পিটিআই বধ্যভূমিকেতখন আমার বুকে লেগেছিল তাঁর কান্নার সুর। 


 দোহাই :

১. আবদুল মালীক ফারুক, যুদ্ধযাত্রা একাত্তর, বিয়ানীবাজার, সিলেট, ২০১৬

২. আশফাক হোসেন, মৌলভীবাজারে মুক্তিযুদ্ধ, মৌলভীবাজার, ১৯৯৭

৩. শেখ ফজলে এলাহী, মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলা, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ২০১১

৪. সরওয়ার আহমদ, জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার, গদ্যপদ্য প্রকাশক, ঢাকা, ২০১৩

৫. মেজর জেনারেল সরোয়ার আহমদ, ১৯৭১: প্রতিরোধ সংগ্রাম বিজয়, প্রিয়মুখ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯

৬. সুরঞ্জনা মায়া, ১৯৭১: কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ, একরঙ্গা এক ঘুড়ি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২০ (গ্রন্থে তিনি মৌলভীবাজারের স্মৃতিচারণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভীবাজারের হাবিব ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন।)

প্রবন্ধ: ১.  মোহাম্মদ আজিজুর রহমান, গণপরিষদ সদস্য, ২২ অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে লিখিত বক্তব্য। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধদলিলপত্র, পঞ্চদশ খণ্ডে রয়েছে। এবং তাঁর সাক্ষাৎকার।

২. মাহফুজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে কমলগঞ্জ, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিচিতি গ্রন্থে প্রকাশিত প্রবন্ধ, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত,২০২৫


কৃতজ্ঞতা:

১. অজিত শর্মা, অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, তারাপাশা, রাজনগর, মৌলভীবাজার। তিনি পিটিআই-এর ১৯৭০-৭১ শিক্ষাবর্ষে পিটিআই ট্রেনিং-এ ছিলেন।

২. মো. আজিজুর রহমান, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য [প্রয়াত]

৩. এখলাচুর রহমান [মৌলভীবাজার পিটিআই এর বাবুর্চি ছিলেন। পাকসেনারা তাতে দিয়ে ব্যাঙ্কারে রক্ষিত নারীদের রুটি পাঠাতো। তিনি কাছ থেকে অনেক কুকীর্তি দেখেন। বর্তমানে প্রয়াত)

৪. তাছির মিয়া, ফতেপুর, রাজনগর, মৌলভীবাজার (তিনি পিটিআই বধ্যভ‚মি থেকে দ্বৈক্রমে বেঁচে যান)

৫. ফিরোজ মিয়া, দিঘলগজী, সদর, মৌলভীবাজার

৬. রউফ মিয়া, দিঘলগজী, সদর মৌলভীবাজার

৭. লীলা বেগম (লিপি বিবি), কালেঙ্গা, কমলগঞ্জ (বীরাঙ্গণা)

৮. দরাছত আলী (যুদ্ধকালীন সময়ে মৌলভীবাজার পিটিআই-এর অফিস সহায়ক ছিলেন। বর্তমানে প্রয়াত)

৯. মায়া দেবরায়, প্রাক্তন সুপারিনটেনডেন্ট, পিটিআই মৌলভীবাজার

১০. বীর মুক্তিযোদ্ধা সজল চক্রবর্তী, প্রাক্তন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, রাজনগর মৌলভীবাজার

১১. সৈয়দ আব্দুল মতাল্লিব রঞ্জু, মীরের বাড়ি, দরগা মহল্লা, মৌলভীবাজার

(সমাপ্ত)


পূর্বের পর্বগুলো

মৌলভীবাজার পিটিআইয়ে দেশ নির্মাণের করুণ-গাথা (প্রথমপর্ব)


মৌলভীবাজার পিটিআইয়ে দেশ নির্মাণের করুণ-গাথা (দ্বিতীয়পর্ব)